শীতল বরফের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে কিশোর। চড়চড় শব্দ তুলে ভেঙে যাচ্ছে বরফ। টুকরোটা কতখানি বড় হয়ে ভাঙবে তার ওপর নির্ভর করছে তার বাঁচা-মরা। বেশি ছোট হলে উল্টে যাবে। পানিতে তলিয়ে যাবে সে। আর বড় হলে তার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থেকে ভেলায় ভাসার মত ভেসে থাকতে পারবে। চারপাশের বরফ ভাঙার শব্দ হৃৎপিণ্ডটাকে যেন খামচে ধরছে। একভাবে পড়ে থেকে জ্যাকি আর রকির ফেরত আসার অপেক্ষা করতে লাগল।
কতখানি দূরে আছে ওরা দেখার জন্যে আবার মাথা তুলল সে। অবাক হয়ে গেল দুটো মূর্তিকে স্কেইট করে স্নোমোবাইলটার দিকে ছুটে যেতে দেখে। মুসাকে দৌড়ে আসতে দেখল তার দিকে।
বরফ যেখানে ভাঙছে সেখান থেকে খানিকটা দূরে এসে থেমে গেল মুসা।
কাছে এসো না! বরফ ভাঙছে, চিৎকার করে উঠল কিশোর। সরে যাও! সরে যাও! নিজের মাথার পেছন দিকে ইঙ্গিত করল। মেটাল ডিটেক্টরটা তুলে নাও।
দৌড়ে গিয়ে বরফের ওপর পড়ে থাকা মেটাল ডিটেক্টরের লম্বা ডাণ্ডাটা ধরে তুলে নিল মুসা। কি করব এটা দিয়ে?
মধ্যযুগীয় নাইটরা কি করে যুদ্ধ করত মনে আছে?
আগে কি আর জানতাম এখন কাজে লাগবে? তাহলে ইতিহাসের ক্লাসে কখনোই অমনোযোগী হতাম না।
বল্লমের মত ব্যবহার করতে পারো নাকি দেখো। তাহলেই চলবে।
বুঝলাম। আমি যাচ্ছি। ফিরে এসে যেন করফের ওপরই পাই তোমাকে, মুসা বলল।
পাবে, হেসে জবাব দিল কিশোর। সাঁতার কাটার এক বিন্দু ইচ্ছেও আমার নেই।
ঘুরে কিশোরদের দিকে আসছে এখন স্নোমোবাইলটা। পেছন পেছনে তাড়া করে আসছে ছায়ামূর্তি দুটো। কাছে আসতেই বোঝা গেল মূর্তি দুটোর একজন রবিন, আরেকজন পিটার।
ড্রাইভারটাকে বাড়ি মেরে ফেলে দিতে পারো নাকি দেখো, মুসাকে বলল কিশোর।
দৌড় দিল মুসা। ঝাঁকি লেগে বরফের টুকরোটা মূল বরফের গা থেকে আরও খানিক ছুটল, কিশোর যেটাতে পড়ে আছে।
তিন দিক থেকে স্নোমোবাইলটাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে মুসা, রবিন আর পিটার। মুসার হাতের মেটাল ডিটেক্টরের ডাণ্ডাটা মনে হলো বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে ওদের। এগোলেই বাড়ি খাবে বুঝে গেছে। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল। চক্কর দিয়ে স্পীড বাড়িয়ে তীব্র গতিতে ছুটে আসতে শুরু করল মুসাকে লক্ষ্য করে।
জোরে চড়চড় করে উঠল বরফ। লড়াইটার দিকে আর নজর দিতে পারল না কিশোর। চোখ ফেরাতে হলো নিজের চারপাশের বরফের দিকে। কানে এল মুসার ইয়াহু চিৎকার। পরক্ষণে ধাতুর সঙ্গে ধাতুর বাড়ি লাগার শব্দ। নিশ্চয় ডিটেক্টরের ডাণ্ডা আর আইস পিকের সংঘর্ষ হয়েছে। তারপর হঠাৎ করেই নীরব হয়ে গেল সব। কৌতূহল দমন করতে পারল না কিশোর। দেখার জন্যে মাথা উঁচু করতেই হলো তাকে।
দেখল স্নোমোবাইলটা ছুটে আসছে তার দিকে। ইঞ্জিন বন্ধ। গায়ের ওপর এসে পড়তে আর সামান্যই বাকি। ক্ষণিকের জন্যে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল বাতাস। পরক্ষণে কানের কাছে বিকট এক গর্জন শুনতে পেল সে। তারপর ঝাঁকি। সবশেষে দুলুনি। তলিয়ে যাবার আগের মুহূর্তে দেখল স্নোমোবাইলটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। পানিতে পড়ে একে অন্যকে মই বানিয়ে বেয়ে ওপরে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেছে রকি আর জ্যাকি।
*
বাঁচাও! বাঁচাও! বরফ পানিতে হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে চিৎকার করে উঠল রকি।
চোরাই মাল বাঁধা দড়িটার একপ্রান্ত থাবা দিয়ে তুলে নিল মুসা। সাবধানে এগোল বরফের মাঝখানের বিশাল গর্তটার দিকে। ওখানেই পড়েছে কিশোর, রকি, জ্যাকি আর স্নোমোবাইলটা। গর্তটা বড় বলেই আবার মাথা তুলতে পেরেছে ওরা, স্রোতের টানে রবিনের মত নিচে চলে যায়নি। বরফের স্তর এত পুরু, বেয়ে ওপরে ওঠা অসম্ভব।
দড়ির মাথাটা কিশোরের দিকে ছুঁড়ে দিল মুসা। ধরো জলদি!
গাধা নাকি! কোথায় ছুঁড়েছে? আমি তো এখানে, ধমকে উঠল জ্যাকি।
অন্ধকারে দাপাদাপি করছে কিশোর। দড়িটা খুঁজে পেল না।
তুলে এনে আবার ছুঁড়ে মারল মুসা। এবার ধরতে পারল কিশোর।
বরফকে বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। ভাঙা গর্তের এতটা কিনারে চলে এসেছে, যে কোন মুহূর্তে ওর ভারে ওই জায়গাটাও ভেঙে পড়তে পারে। দড়ির আরেক মাথা থেকে ব্যাগটা খুলে ফেলে দিয়ে মাথাটা নিজের কোমরে পেঁচিয়ে নিল। চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে কিশোরকে টেনে নিয়ে সামনে এগোল। যখন বুঝল, এখানে বরফ ভাঙার ভয় আর নেই, উঠে দাঁড়াল।
নাক দিয়ে দম টেনে মুখ দিয়ে ছাড়ল। একটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে আগে বাডল। পিচ্ছিল বরফে নিজের দেহটাকে নিয়েই হাঁটা কঠিন, তার ওর ভারী বোঝা টেনে এগোতে হচ্ছে। বার বার পিছলে পড়ার হাত থেকে বাঁচাতে হচ্ছে নিজেকে। গতি বড় ধীর। কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে কিশোর?
যতক্ষণ পারে পারুক। ওসব ভেবে লাভ নেই। নিজের কাজ করে গেল মুসা।
থামা, দম নেয়া, আগে বাড়া!
থামা, দম নেয়া, আগে বাড়া!
কতক্ষণ যে এ রকম করে এগোল বলতে পারবে না। দড়িতে ঢিল পড়তেই ধড়াস করে উঠল বুকের মধ্যে। মনে হলো দড়ি ছেড়ে দিয়েছে কিশোর। কিংবা দড়িটা ছুটে গেছে তার হাত থেকে।
ঘুরে গর্তের দিকে দৌড় দিতে গেল সে। কখন যে চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে। মেঘের নিচে খেয়ালই করেনি। আলো নেই। অন্ধকারে কিছু দেখতে পেল না। কিসে যেন হোঁচট খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। কনুই আর হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে গুঙিয়ে উঠল।