ওপরের গাড়িটাতে টর্চের আলো স্থির রেখেছে কিশোর। গাড়ির পেছন দিকটা নিচু হয়ে গেছে অনেক। মুসা, সাবধান। আস্তে চাপ দাও।
শাবলে হাতের চাপ কমিয়ে ফেলল মুসা। কিন্তু চাপ ছাড়া খুলব কি করে?
আস্তে আস্তে চাপ বাড়িয়ে দেখো কি হয়।
ওপরের গাড়িটার দিক থেকে চোখ সরাচ্ছে না কিশোর। মুসা চাপ কমাতেই স্থির হয়ে গেল ওটা। ঠিক আছে। চাপ দাও আবার।
ট্রাংকের মধ্যে শাবলের মাথাটা আরও কয়েক ইঞ্চি ঢুকিয়ে দিল মুসা। ধীরে ধীরে চাপ বাড়াতে থাকল। বাঁকতে শুরু করেছে তালার কাছটা।
থামো! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
চাপ কমিয়ে দিল মুসা। ওপরের গাড়িটাকে দুলুনি বন্ধ হওয়ার সময় দিল।
ডগলাস, ডেকে বলল মুসা, আবার! রেডি!
শাবল দিয়ে জোরে এক চাড় মারল মুসা। লাফ দিয়ে ওপরে উঠে গেল ট্রাংকের ডালা। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগল দ্বিতীয় গাড়িটাতে। দুলুনি অনেক বেড়ে গেল ওপরের গাড়িটার।
উঠে বসতেও প্রচুর সময় লাগিয়ে দিল ডগলাস। ঠাণ্ডার মধ্যে এ ভাবে আটকে থেকে আড়ষ্ট হয়ে গেছে শরীর। বড় বেশি ধীরে নড়ছে। শাবলটা ফেলে দিয়ে তার হাত চেপে ধরল মুসা।
পড়ে যাচ্ছে! চিৎকার করে উঠল রয়।
পেছনে ঢলে পিছলে পড়তে শুরু করেছে ওপরের গাড়িটা। দৌড়ে সরে গেল। রয়। লাফ দিয়ে গিয়ে সামনে পড়ল কিশোর। ডগলাসের আরেক হাত চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। সে আর মুসা মিলে প্রায় চ্যাংদোলা করে বের করে নিয়ে এল ডগলাসকে। তাল সামলাতে না পেরে তুষারের ওপর পড়ে গেল তিনজনেই। নিচে পড়ল ওপরের গাড়িটা। অল্পের জন্যে বেঁচে গেল ওরা। ময়লা সহ তুষারের কণা এসে ছিটকে পড়ল ওদের গায়ে।
খাড়া হয়ে রয়েছে গাড়িটা। হুডের প্রায় পুরোটাই ঢুকে গেছে কঠিন বরফে।
চলুন এবার ভেতরে যাওয়া যাক, মুসা বলল।
কি মনে করে এখানে এসেছিলে তোমরা? জিজ্ঞেস করল ডগলাস। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে গিয়ে দেখল ঠিকমত পা ফেলতে পারছে না। ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে যাওয়া পা ফেলে কোনমতে খুড়িয়ে হাঁটতে লাগল।
আপনার ট্রাক নিয়ে আমাদের ভয় দেখাতে গিয়েছিল কেউ, মুসা বলল। লেকের মাঝখানে।
আমি যাইনি। যাওয়ার অবস্থায় যে ছিলাম না দেখলেই তো। অফিসের দিকে এগোনোর সময় শঙ্কিত ভঙ্গিতে চারপাশে তাকাল ডগলাস। পুটি কোথায়?
অফিসের ভেতরে, জবাব দিল কিশোর। মনে হয় ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে।
খোঁড়াতে খোঁড়াতেই দৌড়ে গিয়ে অফিসে ঢুকল ডগলাস। হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল কুকুরটাকে।
কি করেছে তোকে ওরা, পুটি!
আধখাওয়া মাংসের টুকরোটার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসল কিশোর। সাদা পাউডার ছড়ানো রয়েছে মাংসের ওপর। বলল, যা অনুমান করেছিলাম। ঘুমের ওষুধ গুঁড়ো করে দিয়েছে। আরও কিছুক্ষণ গভীর ঘুম ঘুমাবে।
ঘুমটা ভাঙলেই বাঁচি, উদ্বিগ্ন শোনাল ডগলাসের কণ্ঠ। মাটিতে থাকলে ঠাণ্ডা লাগবে, সে-জন্যে কুকুরটাকে কাউচে শুইয়ে দিল সে।
পুলিশকে ফোন করে আসি, মুসা বলল।
ডগলাসকে বলল কিশোর, সাইডারের রস গরম করে দেব? খাবেন? গা গরম হবে।
কালো কফি। ফুটন্ত। এবং অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে।
দিচ্ছি।
বাধা দিল রয়, তুমি বসো। আমিই যাচ্ছি। আমারও লাগবে কফি।
মুসা বলল, আমিই বা আর বাদ যাই কেন? যা ঠাণ্ডার ঠাণ্ডা!
ঠিক আছে, আমার জন্যেও এনো, রয়কে বলে ডগলাসের দিকে ফিরল কিশোর। আপনাকে আটকেছিল কে?
দুটো লোক। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার মাথায় একটা ব্যাগ পরিয়ে দিয়ে বয়ে নিয়ে গেল বাইরে।
চিনতে পেরেছেন?
কালো স্কি মাস্ক পরে ছিল মুখে। চেহারা দেখিনি।
কিছু বলেছে?
ভয় দেখিয়েছে।
গলা চিনতে পেরেছেন?
পরিচিতই লেগেছে। তবে চিনতে পারিনি।
জ্যাকসনের নাতিরা না তো?
কুকুরটার গায়ে হাত বোলানো থেমে গেল ডগলাসের। ঠাট্টা করছ?
না।
তাই তো! ঠিকই বলেছ তো! আকার-আকৃতিতে মিলে যায়। গলাটাও ওদেরই মনে হচ্ছে এখন।
ধূমায়িত কফির কাপ নিয়ে হাজির হলো রয়। পেছনে এল মুসা।
পুলিশ আসছে, জানাল সে।
ডগলাস, লেকটার ব্যাপারে আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করি? লেকের ম্যাপটা বের করে ডগলাসকে দেখাল। এই স্পটগুলো দেখুন। কিছু বুঝতে পারছেন?
কি বলতে চাও তুমি? ম্যাপের দিকে তাকাল ডগলাস।
জায়গাগুলোর তালিকা করে লুকিয়ে রেখেছে জ্যাকসনের নাতিরা।
কেন?
সেটাই তো জানার চেষ্টা করছি। আইস ফিশিঙের জন্যেও করা হয়ে থাকতে পারে।
কি যেন ভাবল ডগলাস। উঠে গিয়ে ডেস্কের কাগজপত্রের ভেতর থেকে লেকের একটা ছেঁড়াফাটা ম্যাপ বের করল। পেন্সিল দিয়ে গিজিগিজি করে প্রচুর নোট লেখা তাতে।
দুটো ম্যাপ পাশাপাশি রেখে কয়েক মিনিট মিলিয়ে দেখল। তারপর মাথা নাড়ল, তুমি শিওর, এই ম্যাপটা আইস ফিশিঙের জন্যে করা হয়েছে?
না, শিওর না, জবাব দিল কিশোর।
আমার ধারণা মাছ ধরার জন্যে চিহ্নিত করেনি। ফিশিং স্পট হিসেবে মোটেও ভাল না জায়গাগুলো। ভীষণ বিপজ্জনক। দুএক জায়গায় বঁড়শি ফেলে দেখেছি। খায় না তেমন। অকারণ ঝুঁকি নেয়া। রয়ের ম্যাপটার একটা ক্রস চিহ্নে আঙুল রাখল। এ জায়গাটার নিচ দিয়ে তীব্র স্রোত বয়। বরফকে কোনমতেই একভাবে থাকতে দেয় না। দিনের শেষ ভাগে এখানে রোদও পড়ে বেশি।
তাতে কি? মুসার প্রশ্ন।
রোদ মানেই গরম। আর গরমে বরফের ওপর দিকটা গলে যায়। রাতে আবার শক্ত হয়। এ রকম করতে থাকলে দুর্বল হয়ে যায় বরফ। ওসব জায়গায় মাছ ধরতে গেলে প্রাণের ঝুঁকি নিতে হবে। কে যায়?