দেরি করে লাভ কি? জবাব দিল মুসা। যদিও মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারিনি এখনও আমি।
চলো। যেতে যেতে বলছি।
চাটা খেয়ে নাও, রয় বলল।
*
গাড়িতে এসে উঠল ওরা। জিপিএসটা আর ম্যাপের প্রিন্টআউট সঙ্গে নিয়েছে রয়।
লেকের কাছে যখন পৌঁছল ওরা, অন্ধকার হয়ে গেছে। শীতের ঠাণ্ডা রাত নামছে। তুষার পড়ছে। মেঘে ঢাকা চাঁদ। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ঝোড়ো বাতাস ঝাঁপটা দিয়ে যাচ্ছে। টান মারছে পরনের কয়েক প্রস্থ পোশাকের একেবারে ভেতরেরটা ধরেও।
কষ্ট আর ভোগান্তি জোগাড়ের সমস্ত উপায়গুলো মনে হচ্ছে তোমাদের জানা, গায়ের কোটটা টেনে দিতে দিতে বলল রয়।
এলে কেন? কিশোর বলল। স্পটগুলো খুঁজে বের করো।
কোন রকম ঝুঁকি নিল না সে। গাড়িতে চুরি আছে। সোজা দেখে কয়েকটা ডাল কেটে নিল ছড়ির মত ব্যবহারের জন্যে। ডালগুলো হেঁটেছেটে সাফ করে নিল।
রবিন তো দিনে পড়েছিল বলে রক্ষা। কিশোরের হাত থেকে একটা ডাল নিয়ে নিল মুসা। অন্ধকারের মধ্যে এখন পানিতে পড়লে বাঁচতে হবে না আর।
লেকে নেমে পড়ল ওরা। লাঠি ঠুকতে ঠকতে আগে বাড়ল। ম্যাপ দেখে। এগোল, সবচেয়ে কাছের স্পটটার দিকে। ম্যাপ আর জিপিএস-এর স্ক্রীনের সবুজ আভার দিকে নজর রয়ের। বরফ ঠুকতে ঠকতে আগে আগে চলেছে কিশোর। রয় মাঝখানে। পেছনে মুসা, টর্চের আলো ফেলে পথ দেখাচ্ছে।
কিছু দেখতে পাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল রয়।
পাচ্ছি। বরফ। জবাব দিল কিশোর।
বাতাসের গর্জনকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল রয়, কি জিনিস খুঁজতে এসেছি আমরা?
বলতে পারলে খুশি হতাম।
ডাকাতির মাল লুকিয়ে রাখেনি তো স্পটগুলোতে? তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে লেকের পাড়ের বাড়িগুলোকে দেখার চেষ্টা করল রয়।
মনে তো হচ্ছে। এখনও কেউ মাছ ধরছে নাকি দেখা যাক।
বলাটা যত সহজ, করা ততটাই কিংবা তারচেয়েও বেশি কঠিন হলো। তাজা, তুষার বরফ ঢেকে দিচ্ছে। এক জায়গায় এসে থামল রয়। পা দিয়ে খোঁচা মেরে। সেখান থেকে তুষার সরিয়ে দিতে লাগল মুসা। দেখাদেখি কিশোর আর রয়ও তা-ই করতে লাগল। কয়েক মিনিট অবিরাম চেষ্টা করে আট ফুট ব্যাসের গোল একটা জায়গা থেকে তুষার সরিয়ে ফেলল ওরা। নিচের কঠিন বরফ বেরিয়ে এল। টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগল মুসা।
কিছু দেখছ? জিজ্ঞেস করল রয়।
পরিষ্কার করা জায়গাটায় নতুন করে তুষার এনে ফেলছে ঝোড়ো বাতাস।
নাহ্, কিছুই নেই, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল রয়। এ স্রেফ পাগলামি! অকারণ কষ্ট!
এত তাড়াতাড়িই কাবু হয়ে গেলে? তোমার আসার ইচ্ছে দেখে তো মনে হচ্ছিল গোয়েন্দাগিরির খুব শখ? মুসা বলল। গোয়েন্দাগিরিটা কষ্টেরই। আরাম করে এ কাজ হয় না।
থাক থাক। আর লেকচার দেয়া লাগবে না, জবাব দিল রয়।
হাটু গেড়ে বসে পড়ল কিশোর।
পাতলা বরফ নাকি দেখো আগে, সাবধান করল মুসা। রবিনের পড়ে ওয়ার দৃশ্যটা কল্পনা করে শিউরে উঠল নিজের অজান্তেই।
কিছু একটা আছে এখানে, কিশোর বলল। আলোটা আরও সরাও তো দেখি।
কিশোরের নির্দেশিত জায়গায় আলো ফেলল মুসা। বরফের গায়ে একটা খাজমত চোখে পড়ল ওখানে। ম্যানহোলের ঢাকনার চেয়ে ছোট।
একটা গর্ত, কোন সন্দেহ নেই, দেখতে দেখতে বলল কিশোর। বরফ পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে।
আলোটা আরও কাছে নিয়ে এল মুসা। আলোকরশিতে ধরা পড়ল চকচকে ছোট একটা জিনিস। বরফের মধ্যে গেঁথে রয়েছে।
কি ওটা? মুসার প্রশ্ন।
নতুন করে পড়া তুষারে দ্রুত ঢেকে যাচ্ছে জিনিসটা। হাত দিয়ে ডলে পরিষ্কার করে নিল কিশোর। টিনের পাত মনে হচ্ছে।
কোকের ক্যানের হতে পারে। এখানকার মানুষগুলো বড় নোংরা। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে, রয় বলল।
এখানে ময়লা ফেলতে আসবে কে? তা ছাড়া কোকের ক্যানের টিন এ রকম নয়।
তা-ও তো কথা। পরের স্পটটায় দেখব নাকি? রয় বলল। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমিও বরফ হয়ে যাচ্ছি।
চলো, দেখাই যাক, উঠে দাঁড়াল কিশোর।
কি করে খুঁজতে হয় বুঝে ফেলেছে এখন ওরা। পরের স্পটটা বের করতে সময় লাগল না। প্রথমটার মতই একই রকম আরেকটা বুজে যাওয়া গর্ত দেখতে পেল। লেকের বরফের ওপর তুষারের আস্তর জমে আবার বরফ হয়েছে। স্তর দুটো আলাদা ভাবে বোঝা যায়।
এখানেও তো তেমন কিছু দেখছি না, হতাশ ভঙ্গিতে বলল কিশোর। দেখি, আরেকটা।
এত ঠাণ্ডা, উফ! রয় বলল।
ঠাণ্ডার জায়গায় ঠাণ্ডা তো হবেই, উঠে দাঁড়িয়ে রয়ের হাত থেকে ম্যাপটা নিয়ে নিল কিশোর।
তৃতীয় স্পটটায় এসে আবার গোল করে বরফ পরিষ্কার করল। আগের দুটোর মতই গোল একটা গর্তের চিহ্ন। বুজে গেছে বরফে। এটার মাঝখানেও প্রথমটার মত টিন গোঁজা।
নাহ, এখানকার লোকগুলো সত্যি… বলতে গেল রয়।
চুপ! ওকে থামিয়ে দিল মুসা। আলো নিভিয়ে দিল।
কি হয়েছে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রয়।
শব্দ, কান পেতে আছে মুসা। ইঞ্জিনের।
ওদের পায়ের নিচের বরফে শব্দ বাড়ি দিতে শুরু করল। বাড়তে লাগল। ক্রমে। মুহূর্ত পরেই বোঝা গেল ওটা ইঞ্জিনের শব্দ। বরফে আঘাত হানাতে ওরকম শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে। ঘুরে সেদিকে টর্চের আলো ফেলল মুসা। চকচকে ক্রোমের ওপর গিয়ে পড়ল আলো।
পালাও! চিৎকার করে উঠল কিশোর।
একটা ট্রাককে ছুটে আসতে দেখা গেল ওদের দিকে। সে আর রয় ঘুরে ডাইভ দিয়ে পড়ল এক দিকে। মুসা আরেক দিকে। কয়েক ইঞ্চির জন্যে বেঁচে গেল কিশোর। তার পাশ দিয়ে ট্রাকটা যাওয়ার সময় টর্চের আলোয় দেখতে পেল বডিতে লেখা: মেরিন ডগলাস স্যালভিজ।