ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল যেন কিশোর। তার গায়ের ওপর এসে পড়ল মুসা। কি হয়েছে?
পাতলা বরফ, স্থির দাঁড়িয়ে থেকে জবাব দিল রবিন। তোমরা যেখানে আছে, ওখানেও পাতলা। নোড়া না।
পাতলা বরফে কি করতে হয় জানা আছে মুসার। এক মুহূর্ত দেরি না করে। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। শরীরের ভার বিশেষ এক জায়গায় না রেখে ছড়িয়ে দিল। মাত্র কয়েক ফুট সামনে দাঁড়ানো রবিনকে বলল, শুয়ে পড়ো। খুব ধীরে ধীরে।
মুসার দেখাদেখি কিশোরও একই ভঙ্গিতে বরফের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ রবিনের দিকে।
সামনের দিকে দুই হাত লম্বা করে দিল মুসা। রবিনকে ধরার জন্যে।
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। বরফ ভেঙে জোরাল একটা ঝপাৎ শব্দ করে পানিতে পড়ে গেল রবিন।
ভাসল না আর।
.
১০.
রবিন! চিৎকার করে উঠল মুসা। ভাবল, ডাক শুনে বরফের গর্তটা দিয়ে মাথা তুলবে রবিন। কিন্তু ঝপাৎ শব্দটার পর আর কোন শব্দই কানে এল না তার।
হামাগুড়ি দিয়ে গর্তটার দিকে এগোল সে।
বরফ-শীতল পানিতে শুধু বরফের টুকরো ভেসে থাকতে দেখল।
গর্তটার মধ্যে রবিনকে ভেসে ওঠার জন্যে কয়েক সেকেন্ড সময় দিল। কিশোর। তারপর চেঁচানো শুরু করল, আপনারা জলদি আসুন! রবিন পড়ে গেছে! পড়ে গেছে!
মুহূর্তের মধ্যেই চতুর্দিক থেকে দৌড়ে আসতে শুরু করল মাছ শিকারীরা। কারও হাতে ইস্পাতের ভারী শিক, কারও হাতে বরফ ছিদ্র করার ড্রিল মেশিন। অবাক হয়ে দেখল কিশোর, উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে আসছে না। বরং ৬জনখানেক দূরের কয়েকটা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে এসো! কিশোরদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল একজন শিকারী। স্রোতের টানের মধ্যে পড়েছে সে। দ্রুত সরে যাচ্ছে।
স্রোত!
তারমানে ওপরটা জমাট বরফ হয়ে গেলেও নিচের পানিতে ঠিকই স্রোত প্রবাহমান। এতক্ষণে বোঝা গেল কেন পানিতে পড়ে মাথা তোলেনি রবিন। তুলতে পারেনি আসলে। বরফের নিচে চলে গেছে সে।
পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরে শিউরে উঠল কিশোর। দম নিতে পারছে না রবিন। সেই সঙ্গে মারাত্মক ঠাণ্ডা পানি।
ওসব ভাবনা-চিন্তার ধার দিয়ে গেল না মুসা। যা করার, সেটাই করল। পাতলা বরফের কাছ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত পিছিয়ে গেল সে। লাফ দিয়ে উঠে দৌড় দিল শিকারীদের দিকে।
মরিয়া হয়ে ততক্ষণে বরফকে আক্রমণ করেছে ওরা। আইস বার দিয়ে খোঁচাচ্ছে কেউ, কেউ কোপাচ্ছে কুড়াল দিয়ে, বাকিরা ব্যবহার করছে ড্রিল মেশিন।
বরফের নিচে রবিনের হলুদ রঙের পার্কাটা সরে যেতে দেখা গেল পলকের জন্যে।
এই যে এখানে। এখানে! চিৎকার করে উঠল মুসা।
কোন দিকে ভেসে যাচ্ছে রবিন, হাত তুলে দেখাল সে। রবিনের যাত্রাপথে যাতে গর্ত খুঁড়তে পারে শিকারীরা।
কিশোরও উঠে এসেছে। মুসার পাশে দাঁড়িয়ে বরফের নিচে তাকাল। মুখ। তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল রবিন যেদিকে সরছে সেদিকে কোন গর্ত আছে কিনা।
মুসা দৌড় দিল নয় ইঞ্চি গোল একটা সদ্য কাটা গর্তের দিকে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে হাত ঢুকিয়ে দিল গর্তের ভয়ানক ঠাণ্ডা পানিতে। ওখান দিয়ে ভেসে গেলেই খপ করে ধরবে রবিনকে। ওর চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে গেল মাছ শিকারীরা। যে কোন সাহায্যের জন্যে তৈরি।
এই যে আসছে চিৎকার করে বলল একজন শিকারী।
হলুদ রঙের পার্কাটা ভেসে আসতে দেখল মুসাও। হাত আরও খানিকটা পানিতে ঢুকিয়ে দিল। ঠাণ্ডায় অসাড় হয়ে আসছে হাত। রবিনের কষ্টটা আঁচ করতে পারল। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা। বাঁচবে তো রবিন!
এল অবশেষে রবিন। সঙ্গে সঙ্গে তার আস্তিন খামচে ধরল মুসা। টান দিয়ে পানির ওপর তুলে নিয়ে এল রবিনকে। মাথাটা ভেসে উঠল। নাক উঁচু করে লম্বা দম নিতে লাগল রবিন।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। বেঁচে তো আছেই। হুঁশও হারায়নি এখনও রবিন।
তবে বুঝতে পারছে বিপদটা কেবল শুরু। আসল বিপদ আসছে।
উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল শিকারীরা। গর্তের চতুর্দিকের কিনারা কেটে বড় করতে শুরু করল। রবিনকে টেনে তুলে আনার জন্যে।
রবিন, তুমি ঠিক আছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।
ভীষণ ঠাণ্ডা… রবিন জানাল।
আর সামান্য একটু সহ্য করো, মুসা বলল। নিয়ে আসব বের করে।
কিন্তু সে বুঝতে পারছে একটুতে হবে না, গর্তের মুখ বড় করতে অনেক সময় লাগবে। ইতিমধ্যেই প্রায় মিনিট দুয়েক পানিতে কাটিয়ে ফেলেছে রবিন। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এর একটা কারণ, মারাত্মক ঠাণ্ডা পানি তার পেশী শক্ত করে ফেলছে।
গর্তের মুখ বড় করছে শিকারীরা। কিশোর আর মুসা রবিনকে ধরে রেখেছে। টান দিয়ে দেখল, তুলে আনার মত এখনও যথেষ্ট বড় হয়নি ফোকরটা।
ওকে তুলে এনে বরফের ওপর শোয়াতে আরও মিনিটখানেক লাগল।
উফ, ভয়ানক ঠাণ্ডা! কথা বলতে গিয়ে দাঁতে দাতে বাড়ি খাচ্ছে রবিনের। যে বিপদের ভয়টা পাচ্ছিল মুসা, সেটা এসে গেছে। পেশী ঠাণ্ডা হয়েছে। একে একে এখন শরীরের সমস্ত অঙ্গ ঠাণ্ডা হতে থাকবে। কাজ করতে পারবে না। রক্ত চলাচল ব্যহত হবে। দেহের তাপমাত্রা কমে যাবে। এবং সবশেষে দেহ অসাড় হয়ে গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যু।
বাঁচানোর একটাই উপায়। যত দ্রুত সম্ভব গা গরম করা।
ওর গা গরম করা দরকার, মুসা বলার আগেই বলে ফেলল কিশোর।
একজন বলল, জ্যাকসনের ওখানে নিয়ে যাই। সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলল, এই ধরো তো। জলদি করো।