ঢুকে পড়ো। ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে বলল জ্যাকসন। আস্তে কথা বলো। কথা শুনে ভয় পেলে মাছ চলে যাবে।
ঠেলা দিয়ে দরজা খুলল কিশোর। ছোট্ট কেবিনটা জিনিসপত্রে ঠাসা। বেশির ভাগই মাছ ধরার সরঞ্জাম। বালতি থেকে শুরু করে ন্যাকড়া, রীল, নাইলনের সুতো সবই আছে। আর আছে ব্যবহার করে ফেলে দেয়া প্রচুর কফির কাপ। এক কোণে রাখা একটা মোটরচালিত ড্রিল মেশিন। ওটার কর্ক ব্লেডটা এক ফুট চওড়া।
কুঁজো হয়ে চেয়ারে বসে আছে জ্যাকসন। চেয়ারটা এতই পুরানো, হাতলের গদিতে পোর স্পঞ্জ বেরিয়ে পড়েছে। বুড়োর হাতে খাটো একটা ছিপ। সামনে বরফের মধ্যে ফুটখানেক চওড়া গোল একটা গর্ত। সেটা দিয়েছিপের সুতো চলে গেছে নিচে।
আহহা, দরজাটা লাগিয়ে দাও না, রুক্ষ স্বরে বলল বুড়ো। গর্তের নিচের বরফ-শীতল পানিতে ভাসমান একটা লাল-সাদা ফাতনার দিকে চক্ষু স্থির।
ভেতরে জায়গা বলতে নেই। তার মধ্যেই কোনমতে গাদাগাদি করে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।
আগুন লাগার ব্যাপারে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম আপনাকে, কিশোর বলল।
ওই শয়তান ছেলেটার কাজ, পিটার হিগিনস, প্রশ্ন করার আগেই জবাব দিয়ে দিল জ্যাকসন। প্রতিশোধ নিল আমার ওপর। চুরি করায় পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছি বলে।
কাল রাতে ওর সঙ্গে দেখা করেছি আমরা, কিশোর বলল। চুরিটুরিগুলো, বোধহয় ও করেনি।
অ, একরাতেই ওর পক্ষে?
আমাদের কোন পক্ষটক্ষ নেই, স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল কিশোর। আমরা শখের গোয়েন্দা। এই অপরাধের তদন্ত করছি।…এমন হতে পারে, চোরেরাই আপনার ঘরে আগুন দিয়েছে।…আগুনটা দেখলেন কখন?
সাড়ে দশটার দিকে। আমরা তাস খেলছিলাম। আমি, জ্যাকি আর রকি।
কার চোখে পড়ল প্রথমে?
জ্যাকির। বাথরূম থেকে পোড়া গন্ধ পেয়ে দেখতে গিয়েছিল। খানিক পরে বাইরে থেকে ওর আগুন আগুন চেঁচানো শুনে আমরাও গেলাম।
পোড়া গন্ধটা আপনারা পাননি?
প্রথমে পাইনি। পরে পেয়েছি।
আগুন আগুন বলে চেঁচানোর আগে না পরে?
ঠিক মনে করতে পারছি না।
কাউকে দেখেছেন? গাড়ি-টাড়ি বা কোন কিছু?
এতক্ষণে মুখ তুলে তাকাল জ্যাকসন। তোমার কি মনে হয়? আগুন লাগিয়ে আমার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে গেল। দেখতে পেলে ছেড়ে দিতাম?
ফাৎনার দিকে চোখ পড়তেই অস্ফুট চিৎকার দিয়ে উঠল বুড়ো। পানির নিচে চলে গেছে ফানা।
খেয়েছে! বলে উঠল মুসা। চোখ চকচক করছে ফাত্রাটার দিকে তাকিয়ে। বোধহয় হাতও নিশপিশ করছে ছিপটাকে ধরে টান মারার জন্যে।
কথা বোলো না! ফিসফিস করে বলল জ্যাকসূন। খানিকটা সুতো ছাড়ল সে। তারপর ছিপ ধরে টান মারল।
উহহু, গেল ছুটে!যেৎ-ঘোৎ করে উঠল বুড়ো। তোমাদের জন্যে।
তার অভিযোগের ধার দিয়েও গেল না কিশোর। আগের প্রসঙ্গে অটল রইল। পিটার বাদে অন্য কাউকে সন্দেহ হয় আপনার?
না। ভাগ্যিস ভেতরে মূল্যবান কিছু ছিল না। সুতো গুটাতে শুরু করল জ্যাকসন।
দামী কোন জিনিসই নষ্ট হয়নি?
না। ছাউনির চালায় কাল একটা ফুটো দেখতে পায় জ্যাকি। চালা খুলে মেরামত দরকার ছিল। ছাউনির সমস্ত দামী জিনিস দোকানে সরিয়ে ফেলি আমরা।
ছাউনিটা বীমা করানো ছিল?
না।
চুপ হয়ে গেল কিশোর। আর কি জিজ্ঞেস করা যায় ভাবছে।
এই সুযোগে ড্রিল মেশিনটা দেখিয়ে মুসা জিজ্ঞেস করল, মিস্টার জ্যাকসন, ওই জিনিসটা দিয়ে কি করেন?
বরফ ফুটো করি। দুই ফুট পুরু বরফও অনায়াসে ফুটো করে ফেলা যায়।
আরেকটা কথা। শ্যান্টিগুলোর দরজায় নাম-ঠিকানা লেখা কেন?
বোকা নাকি? মানুষের বাড়ির গেটে নাম-ঠিকানা লিখে রাখা হয় কেন? অধৈর্য হয়ে উঠল জ্যাকসন। কোনটা কার বাড়ি চিনে রাখার জন্যে। শ্যান্টির ব্যাপারেও সেই একই কারণ। হাত নেড়ে বলল, এখন তোমরা যাবে? ওসব চুরিদারি আর আগুন লাগানোর ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে ভাল লাগছে না আমার। তবে বরফের মধ্যে মাছ ধরা যদি শিখতে চাও, বসতে পারো।
হা হা, শিখব শিখব! মুসার কণ্ঠে প্রচণ্ড উত্তেজনা।
এখন না। এখন সময় নেই, নিতান্ত বেরসিকের মত বলে উঠল কিশোর। আমাদের অন্য কাজ আছে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, মিস্টার জ্যাকসন।
শ্যান্টি থেকে বেরিয় এল ওরা। খানিকক্ষণ অনিশ্চিত ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করল লেকের ওপর।
রাগ করে মুসা বলল কিশোরকে, কাজ তো কিছু দেখছি না। শুধু শুধু আমার মাছ ধরাটা বন্ধ করলে।
রবিন বলল, এক কাজ করা যায়। মেরিন ডগলাসের সঙ্গে কথা বলতে পারি। চুরি-ডাকাতিগুলোর ব্যাপারে তার কি অভিমত, জানা যাক।
কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে ডগলাসকে?
শার্লিদের বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞেস করার কথা ভাবল কিশোর। কিন্তু সেটা আর করতে হলো না। বেশ কিছুটা দূরে বরফের ওপর নিঃসঙ্গ বসে থাকতে দেখা গেল একটা লোককে। মাথায় লাল ক্যাপ।
হাত তুলে রবিন বলল, ওই যে!
এগিয়ে গেল ওরা। ভুল করেনি রবিন। মেরিন ডগলাসই। বিলাসবহুল কেবিন নেই তার। বাইরে খোলা বরফের ওপর বসে মাছ ধরছে। স্নেডে করে বয়ে এনেছে তার মাছ ধরার সরঞ্জাম। একটা বালতি উল্টো করে রেখে সেটার ওপর বসেছে। জড়সড় হয়ে আছে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটায়।
সাড়া পেয়ে ফিরে তাকাল ডগলাস। আরে রবিন যে। কেমন আছ তোমরা?
ভাল, জবাব দিল রবিন। খাচ্ছে কেমন?
দূর, বিরক্ত ভঙ্গিতে হাত নাড়ল ডগলাস। একেবারেই না। মাছেরও মনে হয় আজ শীত লাগছে। অকারণ কষ্ট করছি। অনেকক্ষণ থেকেই বাড়ি যাবার কথা ভাবছিলাম।