এই নিরু, কি করছ? বলে উঠল আরেকটা নতুন কণ্ঠ।
ফিরে তাকিয়ে কিশোর দেখল, লম্বা একজন লোক। মাথা ভরতি সাদা চুল। গায়ে জু-নেক সোয়েটার, পরনে খাকি প্যান্ট। কোটরে বসা চোখ। অবাক হয়েছে যে বোঝা যায়। পেছনে মুসা আর জিনা।
হাত ধরে কিশোরকে টেনে তুলল মুসা। ব্যথা পেয়েছ?
না, গায়ের ধুলো ঝাড়তে লাগল কিশোর। তবে সময়মত তোমরা না এলে। কি হতো বলা যায় না। এই যে মিস্টার নিরুটি, ইনি একজন মোষ…
নিরু, ধমক দিয়ে বললেন লম্বা ভদ্রলোক, এ সব আর কক্ষনো করবে না। যদি চাকরি করতে চাও এখানে।
আসলে…আমি…ও কম্পিউটারটা ঘাটতে লাগল…
তাই বলে গায়ে হাত তুলবে? জিজ্ঞেস করতে পারতে, টোপাজকে বলতে পারতে, তোমাকে মাতব্বরি করতে কে বলেছে? জানো, ও পিটারের বন্ধু? যাও, কাজে যাও।
চলে গেল নিরু।
হাত বাড়িয়ে দিলেন ভদ্রলোক, ভিনসি জাপা, স্টেজ ম্যানেজার।
কিশোরও হাত বাড়াল। শুরু থেকেই লক্ষ করছে, উচ্চারণ কিছুটা অন্যরকম ভদ্রলোকের; যেমন আর উচ্চারণ করতে গিয়ে কখনও বলেন আউ, কখনও আহ্। ম্যানেজারকে উচ্চারণ করলেন ম্যানেজাহ। জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনার বাড়ি কি নিউ ইয়র্ক সিটিতে?
অবাক হলেন ম্যানেজার, ব্রুকলিন। লং আইল্যান্ড। কি করে বুঝলে?
উচ্চারণ। মোষের কবল থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্যে ধন্যবাদ।
ও কিছু না। নিরু আবার কোন শয়তানি করলে আমাকে বলবে।
আসলে দোষ আমারও আছে। না বলে কম্পিউটার ধরা উচিত হয়নি। আসলে কৌতূহলটা ঠেকাতে পারিনি…
হাসলেন জাপা। আর কোন কৌতূহল আছে? ঘুরে দেখতে চাও জায়গাটা?
হ্যাঁ, মন্দ কি?
মুসার দিকে তাকাল কিশোর। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল। বুঝল মুসা, বলল, তোমরা যাও। আমার হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। আমি বরং এটা দেখি। একটা টেবিলে রাখা স্পোর্টস ম্যাগাজিন টেনে নিল সে। পিটারের দরজার দিকে নজর রাখতে হলে এখান থেকে সরা চলবে না।
ম্যানেজারের সঙ্গে চলল কিশোর আর জিনা। কিশোর ভাবছে, এই নিরু লোকটা কে? পিটারের প্রাণনাশের চেষ্টায় কি তারও হাত আছে? সেজন্যেই সাইনবোর্ডটা পড়ার সময় ক্রেনের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল? তাকে দেখেই বা এত রেগে উঠল কেন?
দু-জনকে নিয়ে স্টেজে উঠে এলেন ম্যানেজার। বললেন, ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড আসলেই একটা বুনো শো। গল্পটা হলো, কয়েকজন আমেরিকান তরুণ, মার্শাল আর্টের ছাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানে আটকা পড়েছিল। তাদের নেতার অভিনয় করবে তোমাদের বন্ধু পিটার। পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়বে এক গুপ্তচর সংস্থার সঙ্গে। পুরানো মন্দির, গুহা, এ রকম অনেক জায়গার মধ্যে লুকাতে হবে তাকে।
সাংঘাতিক ব্যাপার! জিনা বলল।
কয়েকজন শ্রমিক একটা সেট সাজাচ্ছে। দুটো সোফা, একটা কালো টেবিল, তার ওপর একটা টেলিফোন রাখা। মাথায় হেডসেট পরা একজন লোক ফোনে কথা বলছে। আরেকজন পায়চারি করছে, একবার এদিক যাচ্ছে, একবার ওদিক। একটা ব্যালকনিতে গিয়ে উঁকি দিল। তার পেছনে একটা দৃশ্যপট, লিভিং রূমের দেয়াল তৈরি করা হয়েছে, তাতে একটা বুককেস।
সহজ সেট, কিশোর বলল। এত লোক কি করছে?
যতটা সহজ দেখছ ততটা নয়, ম্যানেজার বললেন। এত সাধারণ একটা সেট চালাতেও ষোলোজন লোক লাগে।
ষোলো! অবাক হলো জিনা। মাত্র একটা লিভিং রুমের জন্যে?
হেসে উঠলেন জাপা। হ্যাঁ। একজন লোক মাত্র একটা কাজই করে, যেমন যে আসবাব সেট করে সে কেবল সেটাই করে; ল্যাম্প, ফোন যে নাড়াচাড়া করে, তার সেটাই একমাত্র কাজ। আর কোন কাজ করতে দেয়া হবে না তাকে। তাতে জটিলতা বাড়ে। ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রতিটি কাজের জন্যে আবার এক্সট্রা নোক রাখতে হয়, কোন কারণে একজন যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা অন্য কিছু ঘটে তার, আসতে না পারে, তখন কাজ চালানোর জন্যে। বুঝলে কেন এত লোক লাগে?।
শিস দিয়ে উঠল কিশোর। শো-র সময় এত লোক একসঙ্গে কাজ করে কি করে? যোগাযোগ রাখতে গিয়ে গোলমাল হয়ে যায় না?
প্রশ্নটা তাহলে করেই ফেললে। দাঁড়াও, কন্ট্রোল বোর্ডটা দেখাই, তাহলে আন্দাজ করতে পারবে। এখন আর নিরু তোমাকে বিরক্ত করতে আসবে না।
স্টেজের ওপাশ থেকে ভেসে এল ভারি একটা কণ্ঠ, টার্নটেল নড়ছে!
দাঁড়াও, দাঁড়াও! তাড়াতাড়ি হাত তুললেন জাপা। মেঝেতে খাঁজকাটা বিশাল এক গোল চক্রের মধ্যে জিনা আর কিশোরকে নিয়ে এলেন তিনি। টেকনিশিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার চালাও।
ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করল চক্রটা। লিভিং রূমকে ওপরে সরিয়ে দিল। বেরিয়ে পড়ল আরেকটা সেট।
কন্ট্রোল বোর্ডের কাছে গিয়ে মনিটরের সামনে একটা টুল রাখলেন জাপা। শো-র সময় এখানে থাকি আমি, হেডফোন পরে। স্টেজের পেছন দিকে যারা থাকে, তাদের জন্যে নির্দেশ ঢোকানো থাকে কম্পিউটারে। মনিটরে লেখা ফুটতে। থাকে আর দেখে দেখে তাদের যার যার কাজের কথা বলতে থাকি আমি। এ ধরনের সিগন্যালকে আমরা বলি কিউ। এই যেমন, শব্দ আর আলো ঠিক করার ভার যাদের ওপর, তাদের হয়তো বললাম লাইটস থার্টি ফাইভ, গো। দৃশ্যপট যারা ওঠায়-নামায় তাদের কিউ করি টর্চলাইট দিয়ে। কিউর কয়েক সেকেন্ড আগে সাবধান করার জন্যে আলো জ্বালি একবার। রেডি থাকে শ্রমিকেরা। সঙ্কেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করে দেয়।
আর কম্পিউটার নিশ্চয় নির্দেশ বদল করতে কিংবা নতুন করে সাজাতে সাহায্য করে আপনাকে, কিশোর বলল।