এককোণে একটা দরজা। চকচকে একটা ধাতব তারা ঝুলছে ফ্রেমের ওপর থেকে। নিচে প্লাস্টিকের নেমপ্লেট, তাতে লেখা: পিটার হাইয়েম। কিশোর, মুসা আর জিনা এগিয়ে গেল ওটার কাছে। ভেতর থেকে শোনা গেল রাগত কণ্ঠস্বর।
খাইছে! ফিসফিস করে বলল মুসা, খুব রেগে গেছে মনে হয়। এত দুঃখ কিসের?
দেখে আসি, কিশোর বলল। তোমরা থাকো, চোখকান খোলা রাখো। পিটারের ঘরের দরজাটা দেখিয়ে বলল, ওরা বেরোলে আমাকে ডাকবে।
আচ্ছা।
টোপাজের নির্দেশ অমান্য করে স্টেজের দিকে এগোল কিশোর। চুপচাপ দেখল কাঠমিস্ত্রী, টেকনিশিয়ান আর মঞ্চশ্রমিকদের ছোটাছুটি। ইলেকট্রিক ড্রিল মেশিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে ওয়াকিটকিতে চেঁচিয়ে কথা বলা।
হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়ে গেল কিশোরের। এই শব্দ, আলোর উষ্ণতা, সারি সারি সীটের বিশাল শূন্যতা রক্তে দোলা দিতে লাগল তার। সাধারণ জীবন যাত্রা এখান থেকে অনেক দূরে। এখানে, এই থিয়েটারের মধ্যে একদল পেশাদার শিল্পী মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছে একটা ফ্যান্টাসি তৈরির কাজে।
স্টেজের পেছনের মেঝে থেকে বিশাল এক দৃশ্যপট ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে। দেখা যাচ্ছে গুহার দেয়াল-খোঁচা খোঁচা পাথরে বোঝাই, লুকানো আলো প্রতিফলিত হচ্ছে তাতে। বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ী নদী। প্লাস্টার আর নানা উপকরণে তৈরি একটা অসাধারণ সৃষ্টি এটা, বুঝতে পারছে কিশোর। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে শ্রমিকেরা। দড়ি ধরে টেনে তুলছে জিনিসটা। অন্ধকারে এমন ভাবে আড়াল করা আছে দড়িগুলো, কিশোর যেখানে আছে সেখান থেকে দেখা গেলেও সীটে বসা দর্শকদের চোখে পড়বে না কোনমতেই। গুহার দৃশ্যটা ওপরে উঠে যেতেই বেরিয়ে পড়ল আরেকটা দৃশ্য।
সামনের পর্দার দিকে ঘুরল কিশোর। মিটমিট করা, ইলেকট্রিক আলো চোখে পড়ল তার। ভেতরের আরেকটা পর্দার ওপাশে রয়েছে বুক-সমান উঁচু কন্ট্রোল বোর্ড। তাতে অসংখ্য বোতাম, সুইচ আর একটা কম্পিউটার কীবোর্ড। তার ওপরে কাঠের তাকে দেয়ালের সঙ্গে আটকে রাখা হয়েছে একটা মনিটর। ওটার কাছে দেয়ালে হুকে ঝোলানো একসেট হেডফোন।
ডানে-বাঁয়ে দু-দিকেই তাকাল কিশোর। সবাই কাজে ব্যস্ত। এই সুযোগে কম্পিউটারটায় কি আছে দেখার লোভ সামলাতে পারল না সে। সবার অলক্ষে নিঃশব্দে এমিয়ে গেল বোর্ডের কাছে। স্ক্রীনে ইংরেজিতে লেখা:
ওয়াইল্ড! ওয়াইল্ড! ওয়াইল্ড!
গারবার থিয়েটার, লস অ্যাঞ্জেলেস
সাউন্ড, লাইট, অ্যান্ড ফ্রাই কিউজ
জে, বারনারডি, এসএম
জে, ইভারসন, এএসএম
১। লাইট এ কে রেইজেস হ্যান্ড।
২। সাউন্ড এ কে লাস্ট পারসন অন আর্থ!
৩। সাউন্ড সিগন্যাল ফ্রম অর্ক, কনডাকটর
৪। লাইট বয়েজ অ্যাট সেন্টার স্টেজ
প্রেস রিটার্ন টু কনটিনিউ
ইউজ কারসর টু হাইলাইট কিউ
এফ১: কমান্ড মেনু
এফ২: এডিট মেনু
এফ৩: অ্যাড লাইন
এফ8: রেকর্ডার
কীবোর্ড নাড়াচাড়া শুরু করল কিশোর। রোল করে নিচ থেকে ওপরে উঠতে শুরু করল নি। বেরিয়ে আসতে লাগল মেনুর পর মেনু।
অ্যাই! হঠাৎ জোরাল কণ্ঠ হাঁক দিল পেছন থেকে।
ঝট করে কীবোর্ড থেকে উঠে চলে এল কিশোরের হাত। ঘুরে তাকাল সে।
এগিয়ে আসছে একজন তরুণ মঞ্চশ্রমিক। লম্বা লম্বা সোনালি চুল তার। রঙচটা ফ্যানেলের শার্টের হাতা গোটানো। বাহুতে উল্কি দিয়ে ছবি আঁকা।
সন্দেহে ভরা সবুজে চোখ ঘুরিয়ে ধমক দিল লোকটা, এখানে কি?
তাকিয়ে আছে কিশোর। বিড়বিড় করল, এই লোকই পিটারকে সাবধান করেছিল।
কি বললে?
বোর্ডটা পড়ার আগে চিৎকার করে আপনিই পিটারকে সাবধান করেছেন। চেহারাটা মনে আছে।
ভাল। এখন তোমার চেহারাটা এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেই খুশি হব। কম্পিউটারে তোমার কোন কাজ নেই। স্টেজ ম্যানেজার নও তুমি।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, অস্বীকার করছি না। কম্পিউটার দেখলেই লোভ লাগে, খালি টিপতে ইচ্ছে কমে দাঁড়ান, আগের জায়গায় এনে দিই।
কম্পিউটারের দিকে আবার সে ঘুরতেই ভারি থাবা পড়ল কাঁধে। হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিল পেছনে। কানের কাছে কঠিন কণ্ঠে বলল নোকটা, কিচ্ছু করার দরকার নেই তোমার। ভাগো!
আড়চোখে লোকটার হাতের দিকে তাকাল কিশোর। তেলকালি লেগে আছে আঙুলে। তার শার্টে লাগছে। কণ্ঠস্বর শান্ত রাখার চেষ্টা করল, দেখুন, আমার কথাটা আগে শুনুন…
কোন কথা শুনতে চাই না। আবার হ্যাঁচকা টান মারল নোকটা।
ঝাঁ করে কানে রক্ত উঠে গেল কিশোরের। আর ভদ্রতার ধার ধারল না। কঠিন কণ্ঠে বলল, হাত সরান?
দাঁত বের করে হাসল লোকটা, আরি, আবার রাগও করে! জোরে এক ধাক্কা মারল সে। ছেড়ে দিল কাঁধ।
হুমড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল কিশোর, কোনমতে সামলাল। ফিরে তাকিয়ে দেখল হাসছে লোকটা। এগিয়ে আসছে।
রুখে দাঁড়াল সে। বলল, আর এক পা এগোবেন না।
হাসি আরও বাড়ল লোকটার। এগিয়ে আসছে। ধরে ফেলল কিশোরকে।
জুডোর প্যাঁচ কষল কিশোর।
লাভ হলো না। লোকটাও জুড়ো জানে। কিশোরের চেয়ে ওস্তাদ। মাথার ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দিল তাকে।
থ্যাপ করে কাঠের মেঝেতে আছড়ে পড়ল কিশোর।
.
০৪.
খালি মেঝেতে পড়লে ব্যথা পেত। শরীরের অর্ধেক পড়ল মেঝেতে, অর্ধেক দড়ির বান্ডিলের ওপর। আরও কণ্ঠস্বর কানে এল তার। পদশব্দ ছুটে আসছে।
সবার আগে পৌঁছে গেল লোকটা।
শেষ মুহূর্তে ঝটকা দিয়ে মাথা সরিয়ে নিল কিশোর। নইলে বুটের লাথি পড়ত মাথায়।