তোলা হয়েছে সব? জিজ্ঞেস করলেন রূপালী-চুল এক ভদ্রলোক। চেহারাটা মোটেও ভাল না, কুৎসিত না বলে ভয়ঙ্কর বললে ঠিক হয়।
হয়েছে, জবাব এল একটা ক্যামেরার পেছন থেকে। পিটারের রিঅ্যাকশন, সাইনবোর্ডটা পড়ার দৃশ্য…সঅব।
গুড। এসেছিলাম সাধারণ সাক্ষাৎকার নিতে, পেলাম চমৎকার একটা ঘটনা। অ্যাকশন। বিউটিফুল।
এক্সকিউজ মি, এক্সকিউজ মি বলতে বলতে কনুই দিয়ে গুতো মেরে পথ করে। সামনে এগোল কিশোর। পিটারের টুকরো টুকরো কথা কানে আসছে, কিন্তু তাকে দেখতে পাচ্ছে না। না না, আগে দেখিনি…ঠিকই আছি, কোন ক্ষতি হয়নি আমার…।
ভিড়ের কেন্দ্রে ঢুকে পড়ল কিশোর।
পিটারের পাশে বসে আছে নিতা। হাতে মাইক্রোফোন। একটা ক্যামেরার দিকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, আমাকে দেখা যায়?
যায়। শুরু করুন, জবাব দিল ক্যামেরাম্যান।
সঙ্গে সঙ্গে চেহারার ভঙ্গি বদলে গেল নিতার, শুরু হলো অভিনয়, প্রিয় দর্শকমণ্ডলী, আপনাদের চোখের সামনেই ঘটল ঘটনাটা। ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড যে সত্যি বুনো, তার প্রমাণ পেয়ে গেলেন হাতেনাতে। দেখলেন কি করে বিশাল সাইনবোর্ডটা নেমে আসছিল পিটার হাইয়েমের ওপর। মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছিল…।
মাথা? মুখ থেকে রক্ত সরে গেল পিটারের। আমার অতটা কাছে কিন্তু পড়েনি…
মাথা ঝাঁকাল নিতা। আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। ওরকম করে ভর্তা হতে কেউ চায় না। ধ্বংসপটা দেখিয়ে বলল সে, ওখানে গিয়ে একটা ক্লোজআপ নিলে কেমন হয়?
সেদিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল পিটার। বলল, সরি, ড্রেসিং রূমে কাজ আছে আমার। উঠে দাঁড়িয়ে কিশোরের হাত চেপে ধরে টান দিয়ে নিচুস্বরে বলল, এসো। এমন ভঙ্গি করো, যেন তুমি আমার বডিগার্ড।
ওদের কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। জনতার দিকে তাকিয়ে বলল, দয়া করে, এখন সরুন আপনারা। আমাদের কাজ করতে দিন।
লোকে ভাবল, সে থিয়েটারের লোক। নির্দেশ মানল।
ফিরে তাকিয়ে কিশোর দেখল, জিনা আসছে পেছন পেছন। তার পেছনে মুসা। রাস্তায় নেমে গেছে দু-জন ক্যামেরাম্যান, দুটো পুলিশের গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা মোটা এক লোক স্টেজের দরজা খুলে দাঁড়াল। পিটারকে জিজ্ঞেস করল, কোন চোটটোট লাগেনি তো?
না, লাগেনি।
মুসা আর কিশোরের দিকে সন্দিহান চোখে তাকাল মোটা লোকটা। পিটারকে আবার জিজ্ঞেস করল, এরা কারা?
আমার বন্ধু, হেসে বলল পিটার। কিশোরকে বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে কড়া সিকিউরিটি গার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছ তুমি। ওর নাম টোপাজ। অনুমতি না। থাকলে দেশের প্রেসিডেন্টকে ঢুকতে বাধা দেবে।
টোপাজের কঠিন চেহারায় এক চিলতে হাসি ফুটল। সরে ঢোকার জায়গা ছেড়ে দিল কিশোরদের। যাও।
থিয়েটারের ভেতর ঢুকল ওরা। বেশ নীরব। বাইরের কোলাহল ঢুকতে পারে না এখানে। পিটারের সঙ্গে ছোট একটা করিডর ধরে এগোল ওরা। বড় একটা কর্কবোর্ড ঝোলানো আছে দেয়ালে এক ইঞ্চি জায়গাও খালি নেই বোর্ডটায়। নোটিশ আটকে দেয়া হয়েছে পিন দিয়ে। ওটার পাশে টেলিফোন, অনেকগুলো ফোন নম্বর লেখা।
করিডরের শেষ মাথায় একটা আধখোলা দরজা। তাতে নাম লেখা নুরিখ টোপাজ। দরজার ভেতর দিকে একটা পেগবোর্ড থেকে ঝুলছে অনেকগুলো চাবি। টোপাজের অফিসের ডানে আরেকটা দরজা চলে গেছে স্টেজের দিকে।
দাঁড়ান, কিশোরদের সেদিকে নিয়ে যেতে দেখে পিটারকে ডাকল টোপাজ। ড্রেসিং রুমে লোক আছে। অচেনা কাউকে দেখলে খুশি হবেন না।
ফিরে তাকাল পিটার, কে?
মিস্টার কলিন আর মিস্টার রোম।
ও বলে কিশোরদের দিকে তাকাল পিটার। মিস্টার ডেভন কলিন হলেন প্রডিউসার, আর মিস্টার নরটন রোম মেইন ইনভেস্টর-এই থিয়েটারে সবচেয়ে বেশি টাকা খাটাচ্ছেন তিনি। আবার টোপাজের দিকে ফিরল সে। তো, তাদের সম্মানে কি করতে হবে? কিছু বলেছে নাকি তোমাকে? কণ্ঠস্বরে ঝাঁঝ।
তা বলেছে। গণ্ডগোল শুনে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিলেন দু-জনেই। যখন দেখলেন আপনার কোন ক্ষতি হয়নি, বললেন, মেক শিওর হি গেটস হিয়ার ইন ওয়ান পিস।
তাই বলেছে, না? আমার জন্যে দেখি বড় দরদ, একেবারে দেখেশুনে রাখার হুকুম! স্টেজের দরজার দিকে ঘুরল পিটার। বেশ, দেখেই আসি কি সম্মান দেয়া যায়। খোলা তরোয়াল ঘোরাতে ঘোরাতে যেন দরজা দিয়ে ছুটে ঢুকে পড়ল সে।
কিশোরের দিকে তাকাল মুসা, চোখে বিস্ময়।
লাইনটা শেকসপীয়ারের, কিশোর বলল। যুদ্ধে যাওয়ার সময় রাজা পঞ্চম হেনরি বলেছিলেন তার লোকদের।
চমৎকার! ভোঁতা স্বরে বলল মুসা।
আরেকটা কথা ভাবছি, আনমনে যেন নিজেকেই বলল কিশোর, পিটারকে হুমকি দিয়ে লেখা চিঠিতে বলেছে: রক্তমাখা সিংহাসনে মৃত্যু হবে তার, এবং একটা বন এসে গিলে ফেলবে তাকে।
অদ্ভুত কথা! মাথামুণ্ড বোঝা যায় না।
যায়। আমার মনে হয় এটা কোন নাটকের সংলাপ থেকে নেয়া।
তাতে কি?
আমাদের প্রথম সূত্র।
তারমানে বলতে চাইছ চিঠির লেখক থিয়েটারের লোক? জিনার প্রশ্ন।
মনে হয়। দরজা দিয়ে ঢুকে স্টেজের পেছন দিকে ওদেরকে নিয়ে এগোল কিশোর।
ডানের বন্ধ দরজাটার ভেতরে ঢুকবে না, সাবধান করে দিল টোপাজ। স্টেজের কাছে যাবে না।
ডানে মোড় নিল কিশোর আলো তেমন নেই এখানটায়, অন্ধকার। ঝুড়ি বোঝাই কাপড়, টেবিলে রাখা যন্ত্রপাতি, আর একপাশে একটা নকল মোটরগাড়ি পড়ে আছে। বয়ে স্টেজ, স্পটলাইটের উজ্জল আলোয় আলোকিত।