তুমিই মোটুরাম! বলে উঠল সোনালি-চুল একটা মেয়ে।
এই রে, শুরু হবে এখনি! মোটুরামকে নিয়ে টিটকারি, হাসাহাসি, যে জিনিসকে আজীবন ভয় পেয়ে এসেছে কিশোর। জবাব দিল, আমার নাম মোটুরাম নয়, মোটুরাম হলো চরিত্রটার নাম।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল পিটার। হাত বাড়িয়ে দিল। এখন বুঝি, মস্ত অভিনেতা তুমি! ওই বয়েসেও যা করেছ…অভিনয় তোমার রক্তে মিশে আছে।
পিটারের সঙ্গে হাত মেলাতে গিয়ে বলল ও, তুমিও কম না। আরেকটা কি যেন নাম ছিল তোমার?
বাদ দাও, ওসব ভুলে আছি। এখন আমি পিটার হাইয়েম। এই নামেই চেনে লোকে।…পাগল সংঘ আমার জীবনটাই বদলে দিয়েছে। ওটার পর আর কোন ছবিতে চান্স না পেয়ে বিজ্ঞাপনের কাজ নিলাম। টাকা একেবারেই কম। অনেক কষ্টে কাটতে লাগল দিন। তবে শেষ পর্যন্ত আমার কণ্ঠই আমাকে বাঁচিয়ে দিল। লোকে বুঝতে আরম্ভ করল… হাসল সে। বাকিটা আর শুনে কাজ নেই, ইতিহাস। তোমার খবর কি?
এই আছি একরকম।
অভিনয় করো না?
না। চাচা-চাচীর কাছে থাকি। লেখাপড়া করি। তো, ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড তো খুব নাম করছে…
করবেই। খরচটা কেমন হচ্ছে। লস অ্যাঞ্জেলেসে এ যাবৎ যত মিউজিক্যাল শো হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল এটা। টাকা খরচ করতে কার্পণ্য করছেন না প্রযোজক। লেজার লাইট, মার্শাল আর্ট ডিসপ্লে, উন্নত টেকনোলজি। গল্পটাও নেয়া হয়েছে দারুণ!
জাহির বলল, আমি ওটাতে ড্রামারের কাজ করি। আসলেই টাকা ঢালছেন প্রযোজক-পোশাক, স্টেজ সব কিছু বদলে দিচ্ছেন। নতুন নতুন লোক ভাড়া। করছেন। একমাস হয়ে গেল, অথচ এখনও ওপেন করার তারিখ ঘোষণা করছেন। না।
এক মিনিট, জানতে চাইল মুসা, শো দেখানো মানেই তো ওপেন হয়ে যাওয়া। আবার তারিখ ঘোষণার কি দরকার?
আছে। যেটা চলছে সেটা প্রিভিউ। একটা শো ওপেন করার আগে কয়েক হপ্তা ধরে চলে তার প্রিভিউ। ভুলটুল কোথায় আছে, কি করলে আরও ভাল হবে, বোঝার চেষ্টা চলে। মাঝে মাঝে কান্তারাতি দৃশ্যপট বদলে ফেলা হয়। তারপর যখন মনে হয়, সব একদম পারফেক্ট, কোন ভুল নেই, তখন ঘোষিত হয় ওপেনিং নাইট। পত্রিকার লোকদের দাওয়াত দেয়া হয় সমালোচনার জন্যে।
ওপেনিং নাইট এটার আসবে কিনা তাই ভাবছি! নিচু স্বরে আনমনে বলল পিটার।
কেন, কোন সমস্যা? জানতে চাইল রবিন।
মাথা নাড়ল পিটার। না, কর্তৃপক্ষের কোন সমস্যা নেই। যে কোন দিন ব্রডওয়েতে মুক্তির ঘোষণা দিতে পারে। আর যদি পয়লা রাতেই হিট হয়ে যায়, তাহলে তো কাজই হয়ে গেল। নানা জায়গা থেকে অভিনয়ের ডাক আসবে, ভাড়া নেবে, সিনেমার চুক্তি হবে অনেক টাকা..অনেক।
কালো-চুল সুদর্শন এক লোক টেবিলের ওপাশ থেকে বলে উঠল, আসল কথাটা বলো, পিটার; প্রিভিউ লম্বা করার আরও কারণ আছে।
অপরাধীর হাসি ফুটল পিটারের মুখে। নিজের ঘরের খারাপ কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে অন্যকে শোনানোর কোন মানে হয় না, রলি। ইমপ্রেশন খারাপ করে লাভ কি।
কফি-টফি কিছু লাগবে কারও? জানতে চাইল ওয়েইট্রেস।
জিনা আর তিন গোয়েন্দা চেয়ার টেনে আনল টেবিলের কাছে।
কিশোরের দিকে তাকাল পিটার, এত বছর কি শুধু লেখাপড়াই করেছ?
না, শুধু লেখাপড়া করব কেন? ইলেকট্রনিকের কাজ শিখেছি, ইয়ার্ডে কাজ করেছি, গোয়েন্দাগিরি করছি।
গোয়েন্দা?
পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার কার্ড বের করে দিল কিশোর।
কার্ডটা পড়ে মুখের ভাব বদলে গেল পিটারের। কিশোরের মনে হলো, ক্ষণিকের জন্যে যেন উজ্জ্বল হলো চোখ। সেটা লক্ষ করেই বলল ও, অসুবিধেয় পড়েছ?
অ্যাঁ!…হ্যাঁ! দ্রুত ডানে-বাঁয়ে ঘুরল পিটারের চোখ। হাসল। এই যে এখনকার মত।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। কিছু একটা এড়িয়ে গেল পিটার বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর।
উঠে দাঁড়াল পিটার। পকেট থেকে টাকা বের করে টেবিলে রেখে ওয়েইট্রেসকে ইশারা করে বোঝাল, খাবারের দাম। জাহিরকে বলল, আমি যাই। খানিকক্ষণ তাস খেলে আসি।
রবিনের সঙ্গে কথা বলছে জাহির, আনমনে মাথা ঝকাল। কয়েকটা মেয়েও বসেছে টেবিলে। সমস্বরে বিদায় জানাল পিটারকে।
মুসার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করল কিশোর। রবিনের চোখে চোখেও তাকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সে তখন জিনা আর মেয়েগুলোর সঙ্গে গান নিয়ে তর্ক জুড়েছে।
সুতরাং তাকে ছাড়াই পিটারের পিছু নিল কিশোর আর মুসা। করিডরের শেষ মাথায় চলে এল। একটা দোকানের সামনে করাতে কাটা কাঠের গুঁড়ো স্তূপ হয়ে আছে, আর কিছু তক্তার গাদা। দোকানটা খোলেনি।
এদিক ওদিক তাকাল পিটার। সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকাল, শুড়, এখানে কেউ নেই। কথা বলা যায়। সত্যিই গোয়েন্দা তো তোমরা? মস্করা নয়?
না, মাথা নাড়ল কিশোর। অনেক জটিল কেসের সমাধান করেছি আমরা, ইচ্ছে করলে রকি বীচ থানায় খোঁজ নিতে পারো।
কণ্ঠস্বর খাদে নামাল পিটার, বিশ্বাস আসলে আগেই করেছি, নাহলে এখানে টেনে আনতাম না। বিপদে পড়েছি আমি। মস্ত বিপদ।
বিপদটা কেমন?
আমাকে মেরে ফেলতে চায়।
খাইছে! বলে উঠল মুসা। কেন?
জানলে আর তোমাদের সাহায্য চাইতাম না। গত হপ্তা থেকে কয়েকটা চিঠি আর টেলিফোন পেয়েছি..
কি বলে? জানতে চাইল কিশোর।
কখনও ফোন ধরলেই রেখে দেয়, কখনও ভারি গলায় বলে: ইউ আর গন্যা গেট ইট! কথায় ব্রিটিশ টান। বুড়ো মানুষের মত মনে হয়। কখনও বলে: বিঅ্যাওয়্যার, থেসপিয়ান? কিশোরের দিকে তাকাল পিটার, থেসপিয়ান মানে জানো? পুরানো আমলে অভিনেতাকে থেসপিয়ান বলে ডাকার চল ছিল।