অনেক দিয়েছেন, ধন্যবাদ। ঘুরে করিডরে বেরিয়ে এল কিশোর। ববের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ভাল কথা, আমার বন্ধু জিনা আপনার কাছে মাপ চেয়ে নিতে বলেছে। এখানে আসার আগে বার্গার খেয়েছিল। হাতে তেল লেগে ছিল। মূর্তিটায় লেগে নোংরা হতে পারে, এ জন্যে চিন্তা হচ্ছে তার। অত উত্তেজনার মধ্যে পরে আর মুছতে মনে ছিল না।
মাথা ঝাঁকাল বব। দেখেছি। কাল ওটা তোলার সময় লেগে গিয়েছিল আরকি। ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে হয়েছে আমাকে। গন্ধটা দারুচিনির মত। লাইটের সুইচেও এই জিনিস লক্ষ করেছি।
অবাক হয়েছে যে, সেটা চেহারায় প্রকাশ পেতে দিল না কিশোর। যাই হোক, জিনা আপনাকে সরি বলতে বলেছে।
হাসল বব। ও কিছু না। ওকে অত চিন্তা করতে মানা কোরো। আমি মুছে ফেলেছি।
থ্যাংকস।
সামনের দরজা দিয়ে বেরোল দু-জনে। তালা লাগাতে লাগাতে বব বলল, আবার একদিন এসে যোগ দিতে পারো। তবে মনে হচ্ছে এবার অনুষ্ঠান করতে দেরি হবে। উইলের শান্ত হতে সময় লাগবে।
উইল?
উইলিয়াম শেকসপীয়ার।
ও। ঠিক আছে, যাই। থিয়েটারে দেখা হবে।
আবার পিকআপ নিয়ে ফ্রিওয়েতে বেরিয়ে এল কিশোর। অল্পক্ষণেই স্পীডোমিটারের কাটা উঠে গেল পঞ্চাশ-পঞ্চান্নতে, আর তার মগজের কাটা কয়েক শো-তে। জিনা আর মুসাকে বাদ দিলে, পিটার ছাড়া একমাত্র রলিই বার্গার খেয়েছিল। তার টেনে প্লাগ খুলে, দৌড়ে ঘর পার হয়ে গিয়ে মূর্তি ফেলে এসে সুইচ টিপে মাথার ওপরের আলো জ্বেলে দেয়া–এতগুলো কাজ কি সে করতে পেরেছে অন্ধকারের মধ্যে?
ভুরু কাছাকাছি হয়ে গেল কিশোরের। বব নিজের ব্যাপারেও এই প্রশ্নই তুলেছিল তখন। তবে ববের চেয়ে রলির বয়েস কম। ক্ষিপ্র হওয়া স্বাভাবিক। কাজটা তার জন্যে কঠিন হলেও হয়তো অসম্ভব নয়।
আর যা-ই হোক, শেকসপীয়ারের ভূত এসে মূর্তি ফেলে দিয়েছে, এ কথা কিছুতেই বিশ্বাস করে না কিশোর।
.
১০.
গারবার থিয়েটারের পার্কিং লটে ঢোকার আগে গাড়ির গতি কমাল কিশোর। অনেক লম্বা লাইন পড়েছে টিকেট কাউন্টারের সামনে। নিশ্চয় গতরাতের নিউজ দেখেছে। কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ বোধহয় একেই বলে–বার বার মরতে বসছে পিটার, ব্যবসা করছে অন্য লোক।
এগিয়ে গেল সে। মারাত্মক কতগুলো চোখা কাটা ডিঙিয়ে। প্রিং লাগানো। গাড়ি ঢোকার সময় মাটিতে দেবে থাকে। বেরোনোর সময় লাফ দিয়ে উঠে আসে। টায়ারে লাগলে চিরে ফালাফালা হয়ে যাবে। বেরোনোর একমাত্র পথ তখন, গেট। সুতরাং পার্কের ভাড়া মেরে দেয়ার আর উপায় থাকে না। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার। পার্কিং লটগুলোতে প্রচুর এই জিনিস দেখেছে কিশোর, তারপরেও দেখলেই কেন যেন মধ্যযুগীয় অত্যাচার-কক্ষের কথা মনে পড়ে যায় তার।
গাড়ি পার্ক করে রেখে থিয়েটার স্টেজের দরজার দিকে দৌড় দিল সে।
করিডরে ঢোকার মুখে টোপাজের সঙ্গে দেখা। বাধা দিল না। মাথা নুইয়ে যাওয়ার ইশারা করল। কর্কবোর্ড পার হয়ে এল সে। স্টেজে ঢোকার দরজার ঠিক ওপাশেই মুসা আর পিটারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। পিটারের কপালের দাগটার কোন চিহ্ন নেই এখন।
হেসে বলল কিশোর, বেঁচেই আছ দেখতে পাচ্ছি।
আছি। আর কিছু ঘটেনি।
মুসাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, জিনা আসেনি?
মৃদু আলোকিত একটা কোণ দেখিয়ে মুসা বলল, ওখানে।
নাচছে জিনা।
কি করছে ও? কিশোরের প্রশ্ন।
হাসল মুসা, ভুলে গেছ? করিডরের সাইনটার কথা মনে নেই?
অডিশন নোটিশ? তারমানে সত্যিই সে…
জিনা তো তোমার অচেনা নয়। একবার কিছু করবে বলে গো ধরলে করেই। ছাড়ে।
হু! এইজন্যেই মেয়েদের এড়িয়ে চলতে চাই আমি।
কিন্তু সব সময় সবকিছু চাইলেই কি আর পারা যায়?
লাউডস্পীকারে গমগম করে উঠল পিটারের গলা, শুরু হতে যাচ্ছে কিয়োটো কন মোটো! আজ রাতের সবচেয়ে বড় ড্যান্স নাম্বার।
ঘোষণা শুনে দৌড়ে এল জিনা। মুসা আর কিশোরের সঙ্গে পাশের একটা দরজা দিয়ে ঢুকল অডিয়েন্সে।
ওরা বসতে না বসতে অন্ধকার হয়ে গেল স্টেজ। গুঞ্জন করে উঠল একটা মোটর, মোলায়েম সুরে বাজতে শুরু করল পিয়ানো। অর্কেস্ট্রা পিটের ভেতর থেকে উঠে আসছে মিউজিক।
অন্য বাদকেরা কোথায়? জানতে চাইল মুসা।
আনলেই পয়সা দিতে হবে, জবাব দিল কিলোর। তাই প্রতিটি রিহার্সালে আনা সম্ভব হয় না।
বেশ কিছু আলো জ্বলে উঠল। স্টেজের পেছনে ফুটে উঠল জাপানের একটা দৃশ্য।
হঠাৎ জোরাল হয়ে গেল মিউজিক। পর্দার আড়াল থেকে নাচতে নাচতে ঢুকল। নাচিয়েরা। আলোটা এমন ভঙ্গিতে ফেলা হয়েছে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না ওদের, ছায়াগুলো মনে হচ্ছে একটা আরেকটাকে ভেদ করে যাচ্ছে আড়াআড়ি ভাবে। ওদের শরীরের তীক্ষ্ণ মোচডগুলোতে মার্শাল আর্টের প্রকাশ প্রবল।
মুগ্ধ হয়ে দেখছে কিশোর। হালকা, সরু সরু আলোকরশ্মি যেন বাতাস চিরে ছুটে চলেছে এদিক ওদিক।
আচমকা যেন জমে গেল নর্তকেরা। একেবারে স্থির। একটা পর্দার আড়াল থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এল আরেকজন নর্তক। মনে হলো যেন উড়ে এল বাতাসে ভর করে। আস্তে করে এসে মঞ্চে নামল তার ছায়া। একাই নাচতে শুরু করল।
ওহ, পিটার! বিস্ময় চাপতে পারল না জিনা।
সচল ছায়াটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। পিটার যে ভাল নাচতে পারে জানা ছিল তার, কিন্তু এতটা ভাল কল্পনা করেনি। মুহূর্তে যেন দখল করে নিয়েছে পুরো মঞ্চটা।