বাইরে জুতো খুলে রেখে শুধু মোজা পরে লম্বা, সরু একটা করিডর ধরে এগোল কিশোর, মুসা আর জিনা। শেষ মাথায় ছোট, জানালাবিহীন একটা ঘর। ঢোকার মুখে টেবিলে রাখা একটা আলোকিত টেবিল ল্যাম্পকে মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে ছায়াঘন পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। অদ্ভুত সব চাট ঝোলানো দেয়ালে। গ্রহ-নক্ষত্র আর এমন সব চিহ্ন ও নকশা আঁকা, কিছুই চিনতে পারল না কিশোর। শেকসপীয়ারের একটা শ্বেত পাথরের মূর্তির নিচে একটা পিয়ানো পড়ে আছে।
ঘরের মাঝখানে একটা পুরানো কার্পেট। সেটাতে হাত ধরাধরি করে গোল হয়ে বসেছে অভিনেতারা। চক্রের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে দরজার কাছে বসল বব। তার পাশে বসতে ইশারা করল কিশোর, মুসা ও জিনাকে।
ওরা বসলে অনুষ্ঠান শুরু করল বব। মাপা মাপা নরম গলায় বলল, চোখ বন্ধ করো সবাই নিজেদেরকে পাত্র তৈরি করো চারপাশের শক্তিদের জন্যে।
শিউরে উঠল মুসা। জিনার কাছে মনে হলো হাস্যকর। কিশোর বোঝার চেষ্টা করল কি বলতে চাইছে নাপিত।
কষ্ঠরা আজ এসেছিল আমার কাছে, বব বলছে। ওরা বলেছে তোমাদের কোন একজনের জন্যে আজ রাতে একটা দরজা খোলা থাকবে। এমন একটা দরজা যা শত শত বছর ধরে লুকানো রয়েছে। কার কথা বলছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলেনি। দরজাটা কোন ধরনের জীবনে নিয়ে যাবে তা-ও জানতে চেয়েছি, নীরব থেকেছে ওরা।
নাক টানল একজন অভিনেতা। এই আজব পরিবেশে শব্দটা অবাস্তব লাগল।
আবার কথা বলল বব, বেশ ভারি একধরনের ফিসফিস শব্দ, অনেক যন্ত্রণা, বার বার বলেছে ওরা, তবে সবশেষে কাটবে মহাভার, হালকা হবে শরীর।
খাওয়ার ব্যাপারে সাবধান থাকলে শরীরের ওজন কমে গিয়ে শেষ পর্যন্ত হালকা হবেই, ভাবল কিশোর। অনুভব করল, তার দু-পাশের লোকের ধীরে ধীরে দুলতে আরম্ভ করেছে। গুঞ্জন করতে লাগল দুটো কণ্ঠ।
তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বব বলল, কিজার কথা ভাবো…ধীরে… খুলছে…।
ভূতের ভয় দূর হয়ে গেছে মুসার। ভাবল, তার টয়োটা করোলার দরজা খুলছে। ধীরে ধীরে। পিটম্যান আর্মটা লাগাতে কত সময় লাগবে?
ওই যে… বব বলল, নতুন একটা পরিবর্তন টের পাচ্ছ, বাতাস হঠাৎ করে বদলে গেলে যেমন অনুভূতি হয়?
আর সহ্য করতে পারল না একজন অভিনেতা, হেসে ফেলল। শশশ করে। তাকে থামতে বলল আরেকজন। বব নয়, অন্য কেউ, বুঝতে পারল কিশোর। ওই লোক বোধহয় পুরো ব্যাপারটাই বিশ্বাস করছে। অনেকেই হয়তো করছে, কে জানে!
এখন… বব বলল, দুলতে দুলতে ঢুকে পড়ো নিজেদের গভীরতম সত্তার ভেতরে…আমরা যখন দুলছি, তখন অদৃশ্য শক্তির পরিমাণ বাড়ছে, আগন্তুককে বের করে দেয়া হবে…
দুলতে শুরু করল কিশোর। শান্ত থাকো, নিজেকে বোঝাল সে, জোরাল অটো সাজেশন দেয়ার মত কোন ব্যাপার ঘটছে। ইচ্ছে করলে যোগ দিতে পারো, না করলে…
হ্যাঁ… উত্তেজনায় গলা আটকে আসতে চাইছে ববের, আমার বিশ্বাস ওটা এখানেই আছে…আমার বিশ্বাস তোমাদের মধ্যেও একজন সেটা অনুভব করতে পারছ…হ্যাঁ
পরক্ষণে ঘোর অন্ধকারে ঢেকে গেল ঘরটা। চোখ বোজা অবস্থাতেও সেটা বোঝা যাচ্ছে। নিভে গেছে বাতিটা।
তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার চিরে দিল নীরবতা। থ্যাপ করে কার্পেটের ওপর পড়ল ভারি কিছু।
আপনাআপনি খুলে গেল তার চোখ। চেঁচিয়ে বলল, আলো কই, আলো!
অন্ধকারে নড়াচড়া, দেয়ালে নখ ঘষার শব্দ।
মুসার হাত আঁকড়ে ধরল জিনা।
খাইছে!…কে-ক্কে… তোতলাতে শুরু করল মুসা।
মাথার ওপরে আলো জ্বলে উঠল।
চিৎ হয়ে পড়ে আছে পিটার। চোখ বোজা। কপালের পাশে লাল দাগ।
তার মাথার কাছে পড়ে আছে উইলিয়াম শেকসপীয়ারের মূর্তিটা।
.
০৬.
না, লাগবে না, ঠিকই আছি আমি, আস্তে করে ববের হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিল। পিটার। তার কপালে ভেজা কাপড় রাখতে যাচ্ছিল নাপিত। মূর্তির বাড়িতে কপাল কাটেনি তার, তবে ব্যথাটা জোরেই লেগেছে। ফুলে গেছে। লালচে রঙটা বেগুনী হয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
হাসপাতালে ফোন করি, রিসিভার তুলে নিল মুসা।
না। প্রায় চিৎকার করে উঠল পিটার।
থমকে গেল মুসা।
কিশোরের দিকে তাকাল পিটার, আজ রাতের শো আমি কিছুতেই মিস করতে পারব না! বিপদে পড়ে যাব!
কলিন আর রোমের সঙ্গে পিটারের কথা কাটাকাটির কথা মনে করল কিশোর। বুঝতে পারল, নাটক থেকে তাকে বের করে দেয়া হবে এই ভয় পাচ্ছে সে। সেটা অন্য কেউ বুঝে ফেলার আগেই তাড়াতাড়ি ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেল কিশোর, কি করে পড়ল? টেবিলের ওপর গিয়ে পড়েছিলে নাকি?
কপালের আহত জায়গা ডলল পিটার। না, চোখ বন্ধ করে বসে ছিলাম। হঠাৎ পড়ল মাথার ওপর।
মূর্তিটা আবার আগের জায়গায় তুলে রাখতে রাখতে জিনা বলল, অনেক ভারি। ব্যথা সেই তুলনায় কমই পেয়েছেন।
হাসার চেষ্টা করল পিটার, আমার মা বলত, আমার নাকি লোহার মত কপাল।
আরেকজন অভিনেতা বলল, পড়ল কি ভাবে? টেবিলের কিনারে বসানো ছিল নাকি? হয়তো অদৃশ্য শক্তিরা আসার ফলে ঘরের বাতাসে যে কাঁপুনি উঠেছিল…
হাত তুলে থামিয়ে দিল তাকে কিশোর। টেবিলের কিনারটা দেখছেন না কেমন উঁচু করে তৈরি? তুফান এলেও মূর্তিটা পড়ার কথা নয়।
দরজা দিয়ে মনে হয় প্রেতাত্মাকে আসতে দেয়া উচিত হয়নি, রলি বলল। না দেখে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।
হালকা হাসি শোনা গেল।
কিন্তু রসিকতায় কান দিল না বব। গম্ভীর মুখ করে তাকাল পিটারের দিকে। রহস্যময় কণ্ঠে বলল, তোমার বেলায় কেন এটা ঘটল আশা করি বুঝতে পেরেছ।