কিন্তু টর্চের আলো সাহস জোগাতে পারল না বেশিক্ষণ। ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে উঠল আমার। মনে হলো কেউ যেন আড়ালে থেকে আমাদের ওপর নজর রাখছে।
চারপাশে তাকালাম। সবখানে আলো ফেলে দেখলাম। একপাশে বড় বড় পাথরের চাঙড়। ভাবলাম, ওগুলোর ওপাশে লুকিয়ে নেই তো? কিন্তু বেরোল না কোন জানোয়ার বা আর কিছু। নজর রাখা হচ্ছে-এই অনুভূতিটাও গেল না আমার। বরং মনে হলো যা-ই হোক, সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছে ওটা।
আচমকা আমার হাত খামচে ধরল নিনা।
কি? জিজ্ঞেস করলাম।
শুনছ না? ফিসফিস করে বলল ও।
কান পাতলাম। প্রথমে কিছু শুনলাম না তারপর মনে হলো, হ্যাঁ, শুনছি। বললাম, মৃদু গুঞ্জনের মত না?
মাথা ঝাঁকাল নিনা।
আরেকটু এগোলাম।
গুঞ্জনটা হয়েই চলেছে। বাড়ছে আস্তে আস্তে। যতই এগোলাম, আরও স্পষ্ট হয়ে এল।
দাঁড়িয়ে গেলাম। নিনাও দাঁড়াল আমার সঙ্গে।
এখন আর গুঞ্জন নয়। মনে হলো একটা কণ্ঠ, সুর করে রঅবিন! রঅবিন বলে নাম ধরে ডাকছে আমাকে।
পরস্পরের দিকে তাকালাম আমরা।
তোমাকে চেনে ওটা, নিনা বলল। ওর বাদামী চোখ দুটোতে ভয়, বড় বড় হয়ে গেছে। ও জানে তুমি এখানে এসেছ!
রঅবিন, এসো! রবিন, এসো! বলছে একটা জড়ানো কন্ঠ, কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছে না। তবে মানুষের গলা যে নয়, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
চলো; পালাই! নিনা বলল। আরও জোরে আঁকড়ে ধরেছে আমার হাত। ওটা তোমাকে চেনে। তোমার কাছে কিছু চায়। ভয় লাগছে আমার রবিন, চলো চলে যাই!
গুহামুখের কাছে টেনে নিয়ে চলল আমাকে ও। অনেক পেছনে ফেলে এসেছি ওটা।
ভয় আমিও পেয়েছি। বার বার আমার নাম ধরে ডেকেই চলল কণ্ঠটা, রঅবিন, এসো!
চোখ বুজে ফেললাম। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত বুঝতে পারলাম না কি করব? কল্পনায় ভেসে উঠল মিসেস মারলোর সকাল বেলাকার ভীত মুখ। কানে বাজতে লাগল নিনার কথা–মৃত্যুপুরী থেকে কেউ কোনদিন জীবিত বেরোতে পারেনি। নিজের অজান্তেই হাত চলে গেল গলার কাছে, কালো গুটির মালাটা চেপে ধরলাম। আমার জায়গায় যদি কোন মোহক বীর হতো, কি করত এই পরিস্থিতে পড়লে? মন থেকে পেয়ে গেলাম জবাবটা।
আমি ফিরে যাব না, নিনাকে বললাম। দেখতেই হবে সামনে কি আছে। কেন আমার নাম ধরে ডাকে, কি চায়, জানতে হবে।
কি আর চাইবে? তোমাকে খুন করতে চায়, নিনা বলল। দুজনকেই খুন করবে। সময় থাকতে চলো পালাই।
যেতে ইচ্ছে করলে তুমি চলে যাও আমি এগোব। কবরের প্রহরী
তাহলে আমিও যাব তোমার সঙ্গে।
আবার এগিয়ে চললাম আমরা। সুড়ঙ্গের গভীর থেকে গভীরে। মাথার ওপরে ভেজা চুনাপাথরের ছাত! মৃত্যুর সময় হলে যারা এখানে চলে আসত সেই সব ইনডিয়ান যোদ্ধাদের কথা ভাবলাম,। জোর আনলাম মনে-ওরা আসত সময়মত; আর আমাদের সময়ই হয়নি এখনও, আমার এবং নিনার। সুতরাং বেরোতে পারব না কেন?
হঠাৎ তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার প্রতিধ্বনি তুলল গুহার দেয়ালে। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে তাকালাম। নিনা চিৎকার করেছে। আবার চেঁচিয়ে উঠল সে। আবার। হাত তুলল। থরথর করে কাঁপছে। আমার পেছনে দেখাল।
তাকালাম সেদিকে। মাটিতে রেখেছিলাম টর্চের আলো, ওপর দিকে তুলতে লাগলাম। দুটো প্রবেশ পথ দেখতে পেলাম, সুড়ঙ্গমুখ–একটা আমাদের ডানে, আরেকটা বায়ে। দুটো পথের মাঝখানে দেয়ালের গা থেকে বেরোনো চ্যাপ্টা পাথরে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রাণ কুৎসিত হাসি হাসছে যেন একটা মানুষের খুলি।
.
০৭.
চিৎকার করেই চলেছে নিনা। তাতে আরও ঘাবড়ে গেলাম আমি। হাত গেল কেঁপে। টর্চটা মাটিতে পড়ে নিভে গেল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে চিৎকার বাড়ল ওর। হাতড়ে হাতড়ে ওটা তুলে নিয়ে ঝাঁকি দিতে জ্বলে উঠল আবার।
চেঁচানো বন্ধ হলো ওর। প্রলাপ বকার মত বলতে লাগল, তখনই বলেছিলাম আসা উচিত না, উচিত না, তাও এলে!
ও তো একটা খুলি, যেন কিছুই না এ রকম একটা ভঙ্গি করে আমিও যে ভয় পেয়েছি সেটা চাপা দিয়ে রাখতে চাইলাম।
কি বলছ!
তো আর কি? বহুদিন আগে মারা গিয়েছিল লোকটা।
কি করে বুঝলে?
তুমিই তো বলেছ মৃত্যুর সময় হলে এখানে এসে ঢুকত ইনডিয়ান যোদ্ধারা। সে তো অনেক কাল আগের কথাই।
খুলিটার ওপর আবার আলো ফেললাম আমি। স্কুলের বায়োলজি ক্লাসে কঙ্কাল দেখেছি, খুলিও। জানি ওগুলো দেখতে কেমন হয়। কিন্তু গুহার মধ্যের খুলিটাকে অন্য রকম লাগল। চোখের জায়গার গর্ত দুটো যেন আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। দাঁত বের করে হাসছে বিকট হাসি।
খুলিটার নিচে দুই পাশের দুটো সুড়ঙ্গমুখে আলো ফেলে, দেখতে লাগলাম।
রবিন, নিনা বলল, আমার ধারণা খুলিটা ওখানে রাখা হয়েছে কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে। আমাদের সাবধান করার জন্যে। যাতে ভেতরে না ঢুকি।
এতদূর এসে ফিরে যাব, সাধারণ একটা খুলির ভয়ে? আমি বললাম।
মৃত্যুপুরীতে একটা খুলিও ভয় পাওয়ার জন্যে যথেষ্ট, নিনা বলল। তা ছাড়া। কোন পথটা দিয়ে ঢুকতে হবে আমরা, কি করে বুঝব?
সুড়ঙ্গমুখ দুটোর দিকে তাকিয়ে আছি। দেয়ালের গায়ে কালো দুটো ফোকর। আবার তাকালাম খুলিটার দিকে। চ্যাপ্টা যে পাথরটাতে বসানো তার নিচে আরেকটা গোল পাথর আছে দেখতে অনেকটা চাকার মত। এ রকম আকৃতির। পাথর আর কখনও দেখিনি।
ডানের ফোকরটা দিয়ে বললাম, চলো, ওটাতে ঢুকি।
কেন?
দুজনে দুটোতে ঢুকতে চাও নাকি? আমি ডানেরটায়, তুমি বায়েরটায়?
মাথা খারাপ! একা আমি কিছুতেই যাব না। আর আমার কাছে টর্চও নেই।