না বলার জন্যে মাথা নাড়তে গিয়েও থেমে গেল সে। সানগ্লাসটা তাড়াতাড়ি পরে ফেলে বলল, যাব।
তোমার সাহস আছে। হাসলাম ওর দিকে তাকিয়ে।
সাহস না, যা করছি আমরা, এটা স্রেফ পাগলামি! কপালে খারাপি আছে আজ আমাদের!
সে দেখা যাবে।
শৈলশিরায় উঠে এলাম আমরা। আগে আগে পথ দেখিয়ে চলল নিনা। এখানকার প্রতিটি রাস্তা, গলিঘুপচি ওর চেনা। পায়ে চলা সরু পথগুলো ঢেকে আছে ঝরা পাতায়। দুপাশে কোথাও গাছপালা, ঝোঁপঝাড়, কোথাও একেবারে খালি। শুধু বড় বড় ঘাস। নিনা সঙ্গে এসেছে বলে মনে মনে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম। ও না এলে পথ খুঁজে বের করাই মুশকিল হয়ে যেত।
তবে ভয় যে পাচ্ছে ও, স্পষ্ট বুঝতে পারছি। সে একা নয়, আমিও পাচ্ছি। বিকেল শেষ হয়ে এলেও পাহাড়ের ওপরে তখনও রোদ আছে, বেশ আলো। কিন্তু দিগন্তে যে মেঘ জমেছে সেটা লক্ষ করিনি। যখন করলাম, দেরি হয়ে গেছে তখন। ছড়িয়ে পড়ে ঢেকে দিল সূর্যকে। ধূসর করে দিল আকাশের রঙ। বার বার আকাশের দিকে তাকাতে লাগলাম। বোধহয় সেজন্যেই রাস্তার দিকে ভাল করে নজর দিতে পারিনি। একটা মোড় নিয়ে আচমকা দাঁড়িয়ে গেল নিনা। এখান থেকে সোজা পাহাড়ের মাথায় উঠে গেছে রাস্তাটা। মুহূর্তে অনুমান করে নিলাম এই পথের। মাথায়ই কুকুরটাকে দেখেছিল ও।
যেতে চাও, এখনও বলো? জিজ্ঞেস করল নিনা!
দ্বিধায় পড়ে গেলাম। এত তাড়াতাড়ি যে মেঘে ঢেকে অন্ধকার হয়ে যাবে ভাবিনি।
কি বলো, ফিরে যাব? আবার প্রশ্ন করল নিনা।
না, মনে সাহস এনে বললাম, এতদূর এসে ফিরে যাব না। এতক্ষণেও তো কিছু ঘটল না।
বোকার মত কথা বলে ফেলেছি সেটা আমিও বুঝলাম, নিনাও বুঝল, কিন্তু কিছু বলল না। মৃতের গুহার কাছেই যাইনি তখনও, ঘটবে কি? তবু কথাটা বললাম নিজের মনে সাহস রাখার জন্যে।
পথ বেয়ে উঠতে থাকলাম আমরা। শেষ মাথায় পৌঁছে থামলাম। আরেকটা পথ পাওয়া গেল। সেটা ধরে আরও ওপরে উঠতে লাগলাম। কিছুদূর ওঠার পর বড় বড় কতগুলো পাথরের পাশ কেটে কখনও মোচড় দিয়ে কখনও বা মোড় নিয়ে এগিয়েছে পথটা। পাহাড়ের মাথার কাছে পৌঁছে গেছি আমরা ফিরে তাকিয়ে দেখি অনেক নিচে হারলে ক্রীকের নীল জল। বাকি সব কিছু গাছপালার আড়ালে ঢাকা পড়েছে।
আরও ওপরে উঠতে থাকলাম। পথ ক্রমে সরু হয়ে আসছে। বড় বড় কতগুলো গাছের ভেতর দিয়ে গিয়ে শেষ হলো এই পথটাও। সামনে বেশ বড় একটা আয়তাকার জায়গায় ঘাস জন্মে আছে। তিনপাশ ঘিরে আছে ঘন ঝোঁপঝাড়, গাছপালা; আর বাকি একপাশে পাহাড়ের দেয়াল, খাড়া হয়ে উঠে গেছে ওই পথটা ছাড়া আর কোনদিক দিয়ে জায়গাটাতে ঢোকার উপায় নেই। ঠিক মাঝখানে জন্মে আছে বিশাল এক ওক। গাছটা এতই বড়, পুরো জায়গাটাতে তার ছায়া পড়ে।
নিনা বলল, আয়তাকার জায়গাটাই ইনডিয়ানদের কবরস্থান গাছের পেছনে একটা গুহামুখ দেখা গেল। সেটা মৃত্যুপুরীতে ঢোকার পথ। পাহাড়টা দেখেই অনুমান করা যায়, সুড়ঙ্গটা অনেক গম্ভীর হবে।
০৬.
কবরস্থানে ঢোকার জন্যে পা বাড়াল নিনা। বাধা দিলাম আমি।
বাকা হেসে বলল সে, এবার বোঝো, ভীতুটা কে?
ভয় আমি পাইনি, বললাম বটে, কিন্তু আমি জানি কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললাম, মা বলেছে, এই কবরস্থানে ঢোকার সময় কোনমতেই যেন অশ্রদ্ধা করা না হয়।
বেশ, তুমিই তাহলে আগে যাও। কি করে শ্রদ্ধা করতে হয় আমি জানি না, সরে জায়গা করে দিল আমাকে নিনা।
সরাসরি না ঢুকে গাছপালার কিনার ধরে ঘুরে রওনা হলাম আমরা। গুহামুখের কাছাকাছি গিয়ে ফিরে তাকালাম বিশাল ওকগাছটার দিকে। গোড়া থেকে কিছুটা ওপরে একটা ফোকর। হাত তুলে দেখালাম নিনাকে।
এই এলাকার সবচেয়ে বড় গাছগুলোর একটা ওটা, নিনা বলল। ভেতরটা ফোপরা। ইচ্ছে করলে ঢুকে বসে থাকতে পারো। আমি শুনেছি, পুরো একটা ফুটবল টীম ঢুকে থাকতে পারে ওর মধ্যে।
তাহলেই বোঝো, মানুষ কি রকম বানিয়ে কথা বলে, বললাম। ঢুকতে পারবে বড়জোর দুতিনজন, লোকে বলে এগারোজন। দেখবে, মৃত্যুপুরীর ব্যাপারটাও ওরকম। অনেক বাড়িয়ে বলা হয়েছে।
পাথরের দেয়ালে অনেক বড় একটা কালো গহবরের মত হয়ে আছে। গুহামুখটা। ভেতরে উঁকি দিলাম।
বেশি অন্ধকার, নিনা বলল। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। চলো, বাড়ি চলে যাই।
টর্চ নিয়ে এসেছি, অসুবিধে নেই, বললাম ওকে। কিন্তু তাতেও খুশি হতে পারল না ও।
গুহার ভেতরে কয়েক কদম এগিয়েই থেমে গেলাম। পেছনে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি কালো অন্ধকারে ঢেকে গেছে। অথচ গোধূলিও শেষ হয়নি তখনও। মেঘের কারণে অবেলায় সন্ধ্যা। যাই হোক, এই অন্ধকারের মানে আমাদের জানা। কুকুরটার বেরোনোর সময় হয়েছে। দেখার সময় বেশি পাব না।
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশে আলো ফেললাম। ভেতরের বাতাস ঠাণ্ডা, ভেজা ভেজা। পাথরের গায়ে শ্যাওলা জন্মে আছে।
কিছু দেখতে পাচ্ছ? এমন করে কানের কাছে কথাটা বলল নিনা চমকে গেলাম।
না, ফিসফিস করেই জবাব দিলাম। চলো, এগোই
মাটি তেমন শক্ত না হলেও পাথরের ছড়াছড়ি। যতই ভেতরে এগোলাম, মাথার ওপর উঁচু হতে থাকল ছাত। গুহা না বলে ওটাকে মস্ত এক সুড়ঙ্গ বলাই উচিত। কারণ লম্বা হয়ে আছে। কিছুটা এগোনোর পরই বাক নিল দেয়াল। পেছনে আড়ালে চলে গেল গুহামুখ। অদৃশ্য হয়ে গেল বাইরের পৃথিবী। আকাশ চোখে পড়ে না আর। আলো বলতে এখন শুধু টর্চের ওপর ভরসা। আপনাআপনি আঙুলগুলো শক্ত হয়ে চেপে বসল তাতে। আলো না থাকলে এখানে কি যে ঘটবে কল্পনা করারও সাহস হলো না।