তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন জানোয়ারে এ কাজ করেছে জানেন আপনি?
না, রবিন, জানি না, ঢোক গিলে কোনমতে জবাব দিলেন তিনি, শেয়াল টেয়ালে হবে। ভঙ্গি দেখে মনে হলো হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে শেয়ালের চেয়ে বড় কোন জানোয়ারের কাজ, বললাম তাকে। ভালুক কিংবা নেকড়ে।
আমার চোখের দিকে তাকাতে পারছেন না তিনি। মুখ তুলে তাকালেন হান্টার রিজের দিকে। ওসব জানোয়ার লোকালয়ে আসতে চায় না, গলা কাঁপছে তাঁর।
আপনি ঠিক জানেন?।
জানব না কেন? হারলে ক্রীকেই তো জন্মেছি।
কিছুতেই আমার চোখের দিকে তাকালেন না মিসেস মারলো। রোমারকে আমার হাত থেকে নিতে নিতে বললেন, আয়, রোমার, বাড়ি যাই। আর এ ভাবে যখন তখন ঘর থেকে বেরোবি না, বুঝলি? যাওয়ার জন্যে এত তাড়াহুড়া শুরু করলেন তিনি, ঘুরতে গিয়ে জ্যাকেট আটকে গেল একটা ঝোঁপের বেরিয়ে থাকা ভাঙা ডালের মাথায়। টান দিয়ে সেটা ছাড়িয়ে নিয়ে প্রায় ছুটে চললেন।
মিসেস মারলো, পেছন থেকে চেঁচিয়ে বললাম, কবরের প্রহরীর কাজ নয়তো?
যেন দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। ফিরে তাকালেন, রবিন, তোমার ভালর জন্যেই বলছি, হান্টার রিজের ওপরে পাহাড়ের মাথায় যেয়ো না কখনও। তোমার মা আর বাবাকে বোলো, তারাও যেন না যান। বলবে, আমি বলেছি।
কেন যাব না, মিসেস মারলো? জিজ্ঞেস করলাম।
এত কথা জানার দরকার নেই। যা বলছি, করবে।
.
০৫.
কি করব বুঝতে পারলাম না। সবাই খালি পাহাড়ের মাথায় যেতে মানা করে। নাস্তার পর খানিকক্ষণ হারলে ক্রীক থেকে ঘুরে এলাম। বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করলাম।
দুপুরবেলা বাড়িতে খেতে এলাম। মাকে তখনও বলিনি মরা র্যাকুনটার কথা। বললেই সরিয়ে ফেলবে। ওটাকে ওই অবস্থায় নিনাকে দেখানোর ইচ্ছে আমার। আমি জানতাম, ও আমাদের বাড়িতে আসবেই।
ঠিকই এল। দুপুরের পর। এত দেরি করল কেন, জানতে চাইলাম? বলল, স্কুলে গিয়েছিল।
রাতের ঘটনার কথা জানালাম ওকে। র্যাকুনটার কথা বললাম। দেখতে চাইল সে। নিয়ে গেলাম সেলারে।
নিচে নামলাম দুজনে। শক্ত মার্টিতে পায়ের ছাপ পড়েনি। অতএব কুকুরটাই খুন করেছে কিনা, নিশ্চিত হওয়া গেল না।
গম্ভীর হয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে মরা র্যাকুনটাকে দেখল নিনা।
পরামর্শ চাইলাম, কি করা যায় এটাকে, বলো তো?
ও বলল, এক কাজ করি, কবর দিয়ে দিই।
প্রস্তাবটা পছন্দ হলো আমার। আমাদের বাড়ির পেছনে একটা কবর খুঁড়লাম দুজনে মিলে। তারপর মরা র্যাকুনটাকে তুলে এনে কবর দিলাম। রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে আছে গায়ে। অনেকক্ষণ আগে মরেছে, শক্ত হয়ে গেছে লাশ। কেমন। ঘিনঘিন করতে লাগল। ভালমত মাটি চাপা দিয়ে হাত ধুয়ে এলাম। ফিরে এসে দেখি, ডাল দিয়ে একটা ক্রুশ বানিয়ে কবরে পুঁতে দিয়েছে নিনা।
জিজ্ঞেস করলাম, এটা কেন? ব্যাকুনটা কি খ্রীষ্টান ছিল নাকি?
না সেজন্যে নয়, দিলাম অন্য কারণে। অনেক সময় ভূতে মারা প্রাণীও ভূত হয়ে যায়। কবর থেকে উঠে এটাও যাতে ভূত হতে না পারে সেজন্যে ক্রুশ গেঁথে দিলাম। এই বাধা ডিঙিয়ে যত চেষ্টাই করুক, আর ওঠার সাধ্য হবে না।
কোন মন্তব্য করলাম না। বিকেল প্রায় শেষ। আলো কমে আসছে। শৈলশিরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, প্রহরী কি ওপরেই থাকে সব সময়? কখনও নিচে নামে না?।
এতদিন তো, তাই জানতাম।
তাহলে কিসে মারল র্যাকুনটাকে?
বুঝতে পারছি না, মাথা নাড়তে নাড়তে জবাব দিল নিনা, সত্যিই আমি কিছু বুঝতে পারছি না, রবিন! সব সময় মৃত্যুপুরীর কাছাকাছি থাকে ওটা। দূরে যায় না। লোকালয়ে মানুষের ঘরের কাছে যেতে কেউ কখনও দেখেনি ওটাকে। আমাদের বাড়িটার দিকে ফিরে তাকাল সে। সেলারের দিকে তাকাল। আমার প্রশ্ন, এখন কেন নামল? আর তোমাদের বাড়িতেই বা কেন? সানগ্লাস খুলে নিয়ে ওটার একটা উঁটি কামড়াতে লাগল। গভীরভাবে চিন্তা করছে বোঝা যায়।
জানার একটাই উপায়, নিনা।
কি?
পাহাড়ের মাথায় উঠে দেখতে হবে।
আরেকটু হলে হাত থেকে চশমাটা ফেলে দিয়েছিল নিনা। মাথা খারাপ! কবরের প্রহরী মৃত্যুপুরীতে যাবে!
না গেলে জানব কি করে?
জানার দরকারটা কি?
এত কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারছি না। তা ছাড়া এর একটা বিহিত করা দরকার। এতদিন লোকালয়ে আসত না। এখন আসতে আরম্ভ করেছে। কাল। ব্যাকুন মেরেছে, আজ কিংবা দুদিন পর যে মানুষ মারবে না তার নিশ্চয়তা কি?
মারলে কি করার আছে?
ঠেকাতে হবে ওটাকে।
পারলে তুমি ঠেকাওগে। আমি এর মধ্যে নেই।
ঘটনাটা কি, নিনা? এত ভীতু তো মনে হয় না তোমাকে?
আমি জানি খোঁচাটা লাগবে ওর। মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। আমি ভীতু, না?
নইলে কি?
আমি ভীতু?
যেতে যখন চাও না, ভীতুই তো। তবে তুমি যাই বলো আর না বলো, আমি ওপরে যাবই। ওই মৃত্যুপুরী না দেখে আমার শান্তি নেই।
নিনার চোখ দুটো দ্বিগুণ হয়ে গেল। কারও ঢোকার সাধ্য নেই ওখানে। সব সময় পাহারা দেয় কুকুরটা। যদি ঢোকো, কোনদিন আর বেরোতে পারবে না।
আমি যাব, গোঁয়ারের মত বললাম। মরার সময় হলেই কেবল ওখানে ঢুকত ইনডিয়ানরা, সেজন্যে আর বেরোত না। সুস্থ অবস্থায় কেউ নিশ্চয় ঢুকে দেখেনি বেরোতে পারে কিনা?
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেও বলল না নিনা।
আমি আজই যাব, জেদ চেপে গেছে আমার তখন, অন্ধকার হওয়ার আগেই। তুমি যাবে।