ডানে বায়ে দুদিকেই তাকালাম। চাঁদের আলো খেলে যাচ্ছে ঘাসের ওপর। সেলারের ওপরের পাথরগুলো আগের মতই সাদা, কোথাও কোন ছায়া নেই, আমার পেছনেও নেই।
কিন্তু ছায়া তো ছিল একটা! নাকি চোখের ভুল আমার? বুঝতে পারলাম না।
শৈলশিরার কাছে বনটার দিকে তাকালাম। কোন নড়াচড়া নেই। সব স্বাভাবিক। আকাশে চাঁদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে এক টুকরো মেঘ। মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়েছিল বলেই কি ছায়া নেমেছিল উপত্যকায়? তাই হবে। কিন্তু অন্য ছায়াটা? যেটা আমার ছায়াকে ঢেকে দিয়েছিল? নিঃশ্বাসের শব্দ? এ সবের কি ব্যাখ্যা? হতে পারে কুকুরটা এসে দাঁড়িয়েছিল আমার পেছনে। তাই যদি হবে, তাহলে ভূতুড়ে কুকুর নয় ওটা। যতদূর জানি, ভূতের ছায়া পড়ে না। নিনার কথামত অবশ্য ওই কুকুরটা ভূত হলেও অদ্ভুত। পায়ের ছাপ বসে যায় মাটিতে। ছায়া পড়তেই বা দোষ কি? খুট করে শব্দ যে হয়েছিল একটা আমার পেছনে, সেটাও স্পষ্ট শুনেছি। মন কিংবা কানের ভুল নয়। সময়মত ফিরে তাকাইনি বলে নিজেকে গাধা বলে গাল দিতে লাগলাম। তাকালে একটা বড় রহস্যের সমাধান হয়তো তখনই হয়ে যেত। তাকালে হয়তো ঘাড় মটকে মেরে ফেলত, এই বলে সান্তনাও দিলাম মনকে।
অন্ধকার সেলারটার দিকে তাকালাম আবার। ঠিক করলাম, কাল সকালেই জেনে নেব কি ঢুকেছিল ওখানে। দিনের আলো ফুটলে সেলারে নামব। কিসে চিৎকার করল জানতেই হবে।
ঘরে ফিরে এলাম। বিছানায় শুয়েও ঘুম এল না কখন ভোর হবে, কখন সূর্য উঠবে, কখন নামব সেলারে, দেখতে পাব কিসে করেছে চিৎকার, এই চিন্তায় সময় আর কাটছে না।
তবে ঘুমিয়ে পড়লাম এক সময়। আবার যখন চোখ মেলোম দেখি রোদ উঠেছে। সব কিছুই আলোয় উজ্জ্বল। হাসিখুশি দিন। রাতে যে অমন একটা কাণ্ড ঘটে গেছে বিশ্বাসই হতে চায় না।
বিছানা থেকে নেমেই রওনা হলাম সেলারের দিকে। আগে দেখতে হবে কিসে চিৎকার করেছিল। জানতে হবে স্বপ্ন দেখেছি, না সত্যি।
না, স্বপ্ন নয়। সেলারের কাছাকাছি গিয়ে মাটির দিকে তাকিয়েই থমকে গেলাম। আবার সেই পদচিহ্ন। বড় বড় পায়ের ছাপ। সন্দেহ হলো। বাড়ির চারপাশে খুঁজে দেখলাম, সবখানেই আছে। বাগান, আঙিনা সব ঘুরে তারপর এগিয়েছে সেলারের দিকে। পাহাড়ের ঢালে যেমন দেখেছিলাম, অদ্ভুত সেই ঘষার দাগ এখানেও আছে কোথাও কোথাও, কুকুরটার পায়ের ছাপের পাশে। আরও নানা রকম ছাপ দেখতে পেলাম। ছোট ছোট জানোয়ারের বেশির ভাগই চিনি না।
সেলারের প্রবেশ মুখের কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে ভেতরে উঁকি দিলাম। বাইরে এত আলো থাকলেও ভেতরটা তখনও অন্ধকার।
হঠাৎ মনে হলো আরও বেশি অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। চমকে উঠলাম। আবার! হাঁটু কাঁপতে আরম্ভ করল। ফিরে তাকালাম। চেয়ে দেখি সূর্যের মুখ ঢেকে দিচ্ছে এক টুকরো মেঘ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে ধমক দিলাম-রবিন, অকারণ ভয়ে মনকে আচ্ছন্ন কোরো না। তাতে সত্য আবিষ্কারে ব্যাঘাত ঘটবে।
মেঘ সরে যাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। সরে গিয়ে আবার রোদ উঠল। ফিরে তাকালাম সেলারের দিকে। ভেতরে গলা বাড়িয়ে দিলাম। চোখে অন্ধকার সয়ে আসার অপেক্ষা করছি।
দেখতে পেলাম ওটাকে। একটা ব্যাকুন। গলায় মস্ত একটা ক্ষত। একগাদা রক্তের মধ্যে পড়ে আছে। চিৎকার করার জন্যে হাঁ করেছিল যে, সেই ভঙ্গিতেই রয়েছে মুখটা। চোখ দুটো ভোলা। নিষ্প্রাণ। কিন্তু আতঙ্কের ছাপ মুছে যায়নি তা থেকে।
সেলারের মুখের কাছে হুমড়ি খেয়ে আছি। ড্রামের মত বাজতে আরম্ভ করেছে। হৃৎপিণ্ডটা। তাকিয়ে আছি র্যাকুনের কালো, ছোট ছোট চোখ দুটোর দিকে।
সবাই জানে ব্যাকুন খুব লড়াকু প্রাণী। বেকায়দায় পড়লে ভালুকেও ছাড়ে না, যুঝতে থাকে। কিন্তু এই হতভাগ্য ব্যাকুনটা বাধা দেয়ার কোন সুযোগই পায়নি। শেয়ালে মারেনি ওটাকে, তাহলে ধস্তাধস্তি হতো, পড়ে থাকার ভঙ্গিটা হতো অন্য রকম। কায়োটেও নয়। তার চেয়েও বড় প্রচণ্ড শক্তিশালী কোন জানোয়ারের কাজ। নেকড়ে বা ভালুকের পক্ষে এ ভাবে খুন করা সম্ভব। কিন্তু। সেটা মেনে নিতে পারলাম না। ওসব জানোয়ার হলে সেলারের কাছে পায়ের ছাপ থাকত
তাহলে কিসে? কুকুরটা? সেলারে নেমে দেখলে জানা যাবে, যদি পায়ের ছাপ থাকে। তবে সেলারের মাটি এত শক্ত, পায়ের ছাপ পড়বে বলে মনে হয় না।
মিউ!
এতটাই চমকে উঠলাম, লাফিয়ে সোজা হতে গিয়ে মাথা ঠুকে গেল ওপরের বেরিয়ে থাকা একটা পাথরে মাথাটা ডলতে ডলতে ফিরে তাকিয়ে দেখি রোমার। আমাদের পড়শী মিসেস মারলোর ছোট কালো বেড়ালটা।
র্যাকুনের গন্ধ পেয়ে সেলারে ঢোকার চেষ্টা করা। ধরে ফেললাম।
এই যে, এখানে এসে বসে আছে, পেছন থেকে বলে উঠল একটা মহিলা কণ্ঠ। মিসেস মারলো। একটা বেড়াল আর একটা কুকুর পোষেন। কুকুরটার নাম ববি। রোমারকে আমার হাতে ছটফট করতে দেখে বললেন, যেই একটু ছাড়া। পেয়েছে অমনি চলে এসেছে। সারাটা রাত অস্থির হয়ে ছিল। খালি ডাকাডাকি করেছে।
কেন ডেকেছে বলতে পারি, মিসেস মারলো, বললাম আমি। কারণটা ওই যে ওখানে, হাত তুলে সেলারের দিকে দেখালাম। মিউ মিউ করে ছুটে গিয়ে সেলারে ঢুকতে চাইল আবার রোমার। ছাড়লাম না।
সেলারের ভেতরে উঁকি দিয়েই যেন বিদ্যুতের শক খেয়ে পিছিয়ে গেলেন মিসেস মারলো। মুখ সাদা।