পুরো সজাগ হয়ে গেছি তখন। বাইরে কেউ আছে তাতে আর কোন সন্দেহ রইল না। মোলায়েম পা ফেলে আস্তে আস্তে হাঁটছে সে, কিন্তু শুকনো পাতা তার অস্তিত্ব জাহির করে দিচ্ছে। আমার জানালার কাছে এগিয়ে আসছে পদশব্দ। নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এত ভারী আর জোরাল, কুকুর কখনও ওরকম নিঃশ্বাস ফেলে না। অনেকটা পরিশ্রমে হাঁপিয়ে পড়া মানুষের মত। কি ওটা?
ধীরে ধীরে কমে এল নিঃশ্বাসের শব্দ। আবার পাতায় পা পড়ার মর্মর ধ্বনি। আমার জানালার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগল ওটা।
তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে দৌড়ে নামলাম নিচতলায়। লিভিং রূম পার হয়ে ছুটলাম। মা আর বাবা যাতে শুনতে না পায় সেজন্যে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম সামনের ছড়ানো রেলিঙ দেয়া বারান্দায়।
এ সময় কানে এল চিৎকারটা।
ভয়াবহ আর্তচিৎকার। তাতে যন্ত্রণা তো আছেই, সেই সঙ্গে মিশে আছে আরও কিছু-আতঙ্ক।
তারপর আবার সব চুপচাপ। এতটাই নীরব হয়ে গেল, সন্দেহ হলো, সত্যি চিৎকারটা শুনেছি তো? নাকি সব আমার ভীত, ক্লান্ত মনের কল্পনা? ওপরে বাবা মার ঘরের দিকে তাকালাম, জানালায় আলো জ্বলে কিনা।
আগের মতই অন্ধকার। ওরা কিছু শোনেনি।
আমি কি একাই কি শুনলাম? সন্দেহটা বাড়ল-কল্পনাই করেছি।
চারদিক বড় বেশি নীরব। এতটা কেন? খেয়াল করলাম, হাঁসগুলো ডাকাডাকি বন্ধ করে দিয়েছে। সেটাও অস্বাভাবিক। এ ভাবে চুপ করে যাওয়ার একটাই কারণ, চিৎকারটা কানে গেছে ওদের। তারমানে ভুল শুনিনি আমি। কল্পনা নয়।
কিন্তু এল কোনখান থেকে?
সিঁড়ির দিকে এগোলাম। বারান্দার একধারে রয়েছে বাড়িটার সেলার। আগের। দিন মা আমাকে মাটির নিচের ওই ঘরটা দেখিয়ে বলেছে যে কদিন থাকব ওটাকে আমাদের সবজি রাখার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হবে। অদ্ভুত জায়গায় তৈরি করা হয়েছে সেলারটা। পাহাড়ের গোড়ায়। কতগুলো সাদা পাথরের পর ঢালটা উঠে গেছে চুড়ার সেই শৈলশিরার কাছে, যেটাতে রয়েছে ইনডিয়ানদের কবর।
অনুমান করলাম, চিৎকারটা এসেছে ওই মাটির নিচের ঘর থেকে।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেলারের দিকে এগোলাম। ঢালের দিকে চোখ! কেউ আছে। কিনা দেখছি। বড় বড় ঘাস জন্মে আছে। ঘাসের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে নজর চলে গেল চুড়ার দিকে। তারপর আরও ওপরে, আকাশের দিকে। আধখানা চাঁদ আর অসংখ্য বড় বড় তারা প্রচুর আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে উপত্যকায়। দেখার জন্যে যথেষ্ট। ঢালের ওপর কিছু দেখলাম না। দুই পাশে তাকালাম। নেই। যেটা এসেছিল, চলে গেছে। মনে হলো, তখনকার মত আমি নিরাপদ।
সেলারের কাছে পৌঁছলাম। অনেক বড় একটা গর্তকে যাতে পানি না পড়ে সেভাবে ঢেকেঢুকে নিয়ে জিনিসপত্র রাখার ঘর বানানো হয়েছে। মুখের কাছে ঝুঁকে বসে ভেতরে উঁকি দিলাম। ভেতরে গাঢ় অন্ধকার। টর্চ আনার দরকার ছিল। আরও ঝুঁকে, দুই হাতের তালুতে ভর দিয়ে মাথাটা ঝুলিয়ে দিলাম ভেতরে। তাও কিছু চোখে পড়ল না। সকালে আলোতে ছাড়া দেখতে পারব না চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে পিছিয়ে এলাম।
খুট করে পেছনে একটা শব্দ হলো। পাথরের মূর্তি হয়ে গেলাম যেন।
খেয়াল করলাম, ঝলমলে চাঁদের আলো নেই আর এখন! ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে জ্যোৎস্না। ঢালের ঘাস, আশপাশের জমি, পাথর, গাছপালা সব অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। আমার পেছনে কালো একটা ছায়া বড় হয়ে উঠছে আমার ছায়াও পড়েছে মাটিতে। চাঁদ পেছনে থাকায় ছায়াটা লম্বা হয়ে গেছে অনেক। পেছন থেকে আরও বড় একটা ছায়া ঢেকে দিচ্ছে আমারটাকে। আমি যে ভঙ্গিতে আছি, সেরকমই চার পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো।
ঠিক আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওটা।
.
০৪.
ফিরে তাকানোর সাহস তো হলোই না, চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ঘাড়ে এসে পড়তে লাগল যেন ভারী নিঃশ্বাস। এত বেশি হাঁটু কাঁপতে লাগল মনে হলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাব মাটিতে। ঠাণ্ডা রাতু। তার মধ্যেও ঘামতে শুরু করলাম। নিজের অজান্তে হাত উঠে গেল কালো গুটির মালাটার দিকে। চেপে ধরলাম। অপেক্ষা করছি ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার। গালে গরম নিঃশ্বাস, তারপর ঘাড়ে দাঁত ফোঁটানোর তীক্ষ্ণ ব্যথা বা ওরকম কিছুর।
ওটাও যেন অপেক্ষা করে আছে, আমার পেছনে। আমার আঙুল, আমার হাত, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন কাঁপতে শুরু করল থরথর করে! চিৎকার করতে চাইলাম। স্বর বেরোল না ভয়েই অকেজো হয়ে গেছে যেন স্বরযন্ত্র সামান্যতম। শব্দও করতে পারলাম না। এমনকি দম নিতেও যেন কষ্ট।
প্রচণ্ড গর্জনের পর একটা ভারী শরীর আমার ওপর লাফিয়ে পড়ার অপেক্ষা করছি। কিছুই ঘটল না। চোখ মেলছি না। ভাবছি, যে কোন মুহূর্তে এখন অনুভব করব ব্যথাটা, যে কোন সময়।
জানি না কতক্ষণ ওভাবে চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে কুকুরের মত হয়েছিলাম। কতক্ষণ অপেক্ষা করেছি তাও বলতে পারব না। অবশেষে মনে হলো একটা কিছু করা দরকার আমার চোখ বন্ধ রেখেই খুব ধীরে ধীরে এক দুই তিন করে শুনতে আরম্ভ করলাম। দশ গোণা শেষ হলেই ফিরে তাকাব। ঘুরতে আমি চাই না। ভয়ঙ্কর ওই চেহারাটা দেখার সাহস বা ইচ্ছা কোনটাই আমার নেই। চুপ করে আছি বলে হয়তো কিছু করছে না। নড়াচড়া দেখলেই এসে ঘাড় কামড়ে ধরবে সেই ভয়ও আছে। কিন্তু তবু দেখতে হবে। আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না।
দশ গুনে, চোখ মেলেই ঝটকা দিয়ে ঘাড় ঘোরালাম!