দাও।
হাতটা পেছনে সরিয়ে নিলাম, আগে বলো, ভূতটাকে তুমি দেখার পর কি ঘটল?
দ্বিধা করতে লাগল ও। আগে আমার চশমা দাও।
দিয়ে দিলাম ওটা। চোখে পরে নিল সে। ছাপগুলোর দিকে আরেকবার তাকিয়ে আমার দিকে মুখ তুলল। রাতের বেলাও পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগে আমার, বলেছি না?
মাথা ঝাঁকালাম।
হপ্তা দুই আগে ওরকমই এক রাতে বেরিয়েছিলাম। এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম। একটা রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের ওপরের ঢাল বেয়ে ওপরের মাথা গেছে কবরখানার দিকে, নিচটা উপত্যকায় ওই পথের দিকেই যাচ্ছি, বেড়ানো শেষ হয়েছে আমার, বাড়ি ফিরছি আসলে তখন হঠাৎ করেই চোখে পড়ল ওটাকে ওপরে, পথের একেবারে শেষ মাথায়, কয়েকটা গাছের কাছে।
দেখতে কেমন?
কতবার বলব? কুকুরের মতন। অনেক বড় কুকুর। রীতিমত একটা দৈত্য
কি করলে তখন?
আমার দিকে তাকিয়ে রইল নিনা। কি আবার করব? পাগল নাকি তুমি? ভূতের বিরুদ্ধে কিছু করা যায়? কিছুই করিনি। পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। পা নড়াতে পারছিলাম না তারপর ওটা গায়েব হয়ে গেল।
গায়েব হয়ে গেল মানে?
গায়েব হয়ে গেল মানে-গায়েব একেবারে হাওয়া।
সন্দেহ হলে আমার, জিজ্ঞেস করলাম, সত্যি দেখেছিলে তো?
বুকের ওপর হাত দুটা আড়াআড়ি রেখে দাঁড়াল নিনা। তোমার অবগতির জন্যে একটা কথা জানাই মিস্টার রবিন মিলফোর্ড, যেখানে যে জিনিস থাকে না সেটা আমি দেখি না চিৎকারটার ব্যাপারে কি বলবে? এই ইকটু আগে যে দুজনে। শুনলাম? নাকি সেটাও শুনিনি?
তা শুনেছি অস্বীকার করতে পারলাম না কান পাতলাম। থেমে গেছে চিৎকার।
নিনা, তোমাকে মিথ্যুক বলছি না আসলে ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি না আমি।
এখানে এতদিন আসোনি বলে করোনি।
হয়তো তবে এখানকার ইনডিয়ানদের কথা আমি অনেক কিছুই জানি। আমার মায়ের এক পূর্বপুরুষ ছিলেন মোহক ইনডিয়ান। শার্টের গলার কাছের বোতাম খুলে কলারটা ট্র্যাক করে ধরলাম, এই দেখো!
কি ওটা?
দেখতে পাচ্ছ না একটা মালা? ওয়ামপাম গুটির। তাও আবার কালো গুটি। অনেক বড় মোহক যোদ্ধারাই কেবল এই মালা পরত। মালাটা কয়েক পুরুষ ধরে হাত বদল হতে হতে মার হাতে পড়েছিল। আমার গত জন্মদিনে আমাকে উপহার দিয়েছে মা।
ছুঁয়ে দেখতে পারি?
মালাটা ধরতে দিলাম নিনাকে।
বহুকাল আগে এই উপত্যকায় বাস করত মোহকরা, নিনা বলল। হয়তো তোমার মায়ের পূর্বপুরুষ সেই ইনডিয়ান যোদ্ধাও এই এলাকায়ই ছিলেন।
ছিলেনই তো, আমি বললাম। ওই বাড়িটা তো তার কাছ থেকেই পাওয়া। মালাটার মতই হাত বদল হতে হতে ওটাও মার দখলে এসেছে।
তারমানে তোমার পূর্বপুরুষ সেই ইনডিয়ান যোদ্ধাকেও মৃত্যুপুরীতেই কবর দেয়া হয়েছে?
হতে পারে। ওই মৃত্যুপুরীটা কি, বলো তো?
অনেক বড় একটা গুহা। পাহাড়ের ভেতরে সুড়ঙ্গের মত ঢুকে গেছে। মৃত্যুর সময় হলে ইনডিয়ান যোদ্ধারা গিয়ে ঢুকত ওর মধ্যে। কেবল বীরেরাই ঢুকত, সাধারণ ইনডিয়ানদের জন্যে বারণ! কড়াকড়ি ভাবে এই নিয়ম মেনে চলত ওরা। একবার ঢুকলে কেউ আর জীবিত বেরোতে পারে না ওখান থেকে। সেজন্যেই নাম হয়েছে মৃত্যুপুরী।
তুমি ঢুকেছ কখনও?
রাগ করে মালাটা ছেড়ে দিল নিনা। বললাম না কেউ জীবিত বেরোতে পারে না ওখান থেকে। কেউ না!
তাই?
তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না নাকি? দেখো, রবিন, বোকামি করে কিছু করে বোলো না। ওই চুড়ার কাছে যেয়ো না। গোরস্থানটা থেকে দুরে থাকবে। কোনমতেই মৃত্যুপুরীর ধারেকাছে যাবে না। যদি যাও, কোনদিন আর ফিরবে না, বলে দিলাম। কবরের প্রহরী ছাড়বে না তোমাকে।
গুডবাই জানিয়ে বাড়ি রওনা হলাম দুজনে।
বাড়ি ফিরতে পনেরো মিনিটের বেশি লাগল না আমার। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। ভয়ও পাচ্ছি। চারদিকে নানা রকম শব্দ, আলো থাকতে যেগুলো ছিল না। বার বার মুখ ফিরিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে তাকালাম, কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না।
রাতে ডিনার খেতে বসে মা আর বাবাকে বললাম গোরস্থানটার কথা। ভূতের কথাটা চেপে গেলাম। বললে যদি হাসাহাসি করে? ওই এলাকার অনেক ইতিহাসই জানে মা বলল ইনডিয়ানদের ছয় ছয়টা উপজাতি বাস করেছে ওখানে। গোরস্থানটার কথাও জানে। কথিত আছে-ওটাকে কেউ অবহেলা করলে, ওটার ওপর দিয়ে তাচ্ছিল্য করে হেঁটে গেলে তার ওপর নাকি অভিশাপ নেমে আসে।
খাওয়ার পর পরই শুতে চলে গেল মা আর বাবা। সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়িয়ে ক্লান্ত। কিন্তু আমার ঘুম এল না। বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি করতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম কালো কুকুরটার কথা। ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই, অনেকের কাছেই শুনি। তাহলে নিনা কি দেখল? হতে পারে বড় নেকড়ে অথবা কায়োট। বুনো কুকুরও হতে পরে। মালিককে হারিয়ে বুনো হয়ে গেছে কোন পোষা কুকুর।
কিন্তু হঠাৎ করে ওটা নিচে নামল কেন? আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়েই বা থাকবে কেন?
মনে হচ্ছিল ঘুম আর আসবে না। তবে ঘুমিয়েছি। কতক্ষণ পরে জানি না, জেগে গেলাম। আপনাআপনি খুলে গেল চোখের পাতা। কেন জাগলাম? কিসের। শব্দে? মনে হলো বাইরে কিছু একটা নড়াচড়া করছে।
চুপচাপ বিছানায় পড়ে থেকে কান পেতে রইলাম। প্রথমে রাতের স্বাভাবিক সব শব্দ কানে আসতে থাকল, এই যেমন আমার মাথার কাছে রাখা ঘড়িটা। টিকটিক টিকটিক করেই চলেছে। বাইরে গাছের ডালে বাতাসের কানাকানি। হারলে ক্রীক থেকে ভেসে আসছে রাতচরা হাঁসের ডাক। শুকনো পাতা গড়াচ্ছে। মাটিতে। তারপর আরেক ধরনের শব্দ করে উঠল পাতা। পা পড়লে যেমন হয়। শুকনো পাতা মাড়িয়ে হাঁটছে কেউ।