রাতেও ঘোরাঘুরি করো এই বনের মধ্যে?
করি, তাতে কি? অন্ধকারকে ভয় পাও নাকি তুমি?
প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে ছাপগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নিনা, এগুলো কিসের ছাপ, বলো তো?
মাটির দিকে তাকায়নি এতক্ষণ ও। ছাপগুলো দেখে মুহূর্তে বদলে গেল চেহারা। দাঁত থেকে খসে পড়ল ঘাসের ডগা। সাদা হয়ে গেল মুখ। সানগ্লাস খুলে নিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল আরও ভাল করে দেখার জন্যে। যখন সোজা হলো আবার, চোখ বড় বড় করে ফেলেছে। বাদামী মণি দুটোতে আতঙ্ক।
এখানে কেন এসেছিল ওটা? ফিসফিস করে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল নিনা।
ঢোক গিলোম। জিজ্ঞেস করলাম, কিসে কি করছিল?
প্রহরী, বলল সে, কবরের প্রহরী! ছাপগুলোর কাছ থেকে এমন ভঙ্গিতে সরে গেল মনে হলো ভয় পাচ্ছে।
কবরের প্রহরী?
আবার ছাপগুলোর দিকে তাকাল ও। এত নিচে আর নামেনি কখনও, গলা কাঁপছে ওর। মুঠো করে ফেলেছে হাত।
নিনা?
জবাব না পেয়ে ওর কাধ ধরে কঁকালাম, নিনা, কে ওই কবরের প্রহরী?
আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল ও। একটা কুকুর, রহস্যময় কণ্ঠে বলল। বিশাল। কালো। এত বড় কুকুর কোথাও দেখতে পাবে না আর। তবে ওটা কুকুর নয়।
দ্বিধায় পড়ে গেলাম। বলছে কুকুর, আবার বলে কুকুর নয়, সেটা আবার কি? বললাম, কি যা তা বলছ! হয় কুকুর, নয়তো অন্য কিছু; একসঙ্গে দুটো প্রাণী হতে পারে না।
পারে, নিচুস্বরে জবাব দিল নিনা। ভূত-প্রেতেরা পারে। বিশাল কালো কুকুরের রূপ ধরে থাকে ওটা। দানব!
ওর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কাঁপছে। বিশ্বাস করতে পারলাম না, যত্তসব ফালতু কথা!
তোমার কাছে ফালতু মনে হতে পারে, কিন্তু এ এলাকার সবাই জানে ওটার কথা। পাহাড়ের ওপরে ওই চুড়ার কাছে ইনডিয়ানদের একটা গোরস্থান আছে। বহুকাল আগে নিচের উপত্যকায় বাস করত সেনিকা ইনডিয়ানরা। কবর দিত ওপরে। ওখানে যাদের কবর দেয়া হয়েছে, তাদের পাহারা দেয় ওই ভূতুড়ে কুকুরটা।
তাকিয়ে রইলাম নিনার দিকে। ভূত! প্রেত। দানব! কবরখানা পাহারা দেয় ভূতুড়ে কুকুর। এ সব কি বলছে?
আবার তাকালাম ছাপগুলোর দিকে। কুকুরের পায়ের এতবড় ছাপ আর দেখিনি আমি। দানবই ওটা।
সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার নামল পাহাড়ে। গাছের মাথায় কাপন তুলে বয়ে গেল একঝলক বাতাস। মর্মর শব্দে মাটিতে গড়াল শুকনো ঝরা পাতা।
আমারও ভয় লাগতে আরম্ভ করেছে। ওকে বললাম, ভূতেরা মাটিতে পায়ের ছাপ ফেলে না।
সে কথা আমিও শুনেছি। কিন্তু এই ভূতটা ফেলে। কুকুরের মত গলা ছেড়ে ডাকে। পাহাড়ের ওপর ঘুরে বেড়ায়। এমনকি খুনও করে। আমার দিকে তাকাল ও। রবিন, কখনও পাহাড়ের ওপরে যেয়ো না।
কোনখানে?
শৈলশিরাটা দেখাল নিনা। ওদিকে। বিরাট এক ওক গাছ আছে, তার কাছে মৃত্যুপুরী। গেলে মেরে ফেলবে তোমাকে। সত্যি বলছি, বিশ্বাস করো আমার কথা।
বিরাট ওক। মৃত্যুপুরী। রূপকথার মায়াপুরীর রাক্ষস-খোক্কসের কেচ্ছা শোনাচ্ছে যেন আমাকে নিনা। তাকালাম ওর দিকে। ওর চোখের আতঙ্ক আমাকেও যেন গ্রাস করতে আরম্ভ করল। অদ্ভুত এক অনুভূতি হতে লাগল শরীরে। হাতের তালু ঠাণ্ডা হয়ে এল, মুখের ভেতরটা গেল শুকিয়ে। জোরাল হলো বাতাস। নড়িয়ে দিল ডালপালা। ঝরে পড়তে লাগল আরও অনেক শুকনো পাতা।
তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার শোনা গেল আচমকা। কুকুরের ডাকের মত।
ভীষণ চমকে গিয়ে লাফ দিয়ে আমার কাছে চলে এল নিনা। আমিও লাফিয়ে উঠতাম, কিন্তু পা দুটো মনে হলো বরফের মত জমে গেছে।
কিসের ডাক? জিজ্ঞেস করলাম।
ওটাই তো! ফিসফিস করে বলল নিনা। প্রহরী! সূর্য অস্ত গেলেই ডাকে।
কোনখান থেকে? আমিও ওর মত ফিসফিস শুরু করেছি।
ওই যে বললাম, পাহাড়ের ওপরে, চুড়ার কাছে। ওই যে আবার ডাকছে, ভয়ে ভয়ে বলল নিনা। ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ও। আমি বাড়ি যাচ্ছি।
দাঁড়াও, দাঁড়াও! এক মিনিট, অস্বস্তি লাগছে আমার, ওই ডাক শুনেছ নাকি আরও?
মাথা ঝাঁকাল নিনা।
দেখেছ ওটাকে?
এক মুহূর্ত দ্বিধা করে আবার মাথা ঝাঁকাল সে।
কোথায়?
পাহাড়ের ওপর।
অস্বস্তিটা বাড়ল আমার। তুমি বলছ সব সময় পাহাড়ের ওপর থাকে ওটা। কাল রাতে তাহলে এখানে নেমেছিল কেন? পায়ের ছাপই বলছে, নেমেছিল!
চোখ আরও বড় বড় হয়ে গেল ওর, মুখ সাদা। শুকনো গলায় জবাব দিল, জানি না! এতদিন তো পাহাড়ের ওপরেই থেকেছে ওটা।
কিন্তু কাল রাতে এখানে নেমেছিল। এ জন্যেই ভয় পাচ্ছ তুমি, তাই না?
আমার চোখের দিকে তাকাল নিনা, এর আগে আর কোনদিন নিচে নামেনি ওটা। ছাপগুলোর দিকে তাকাল ও, নিচের উপত্যকার দিকে, তারপর আবার আমার দিকে। কাল রাতে এখানে নেমে তোমাদের বাড়িটার দিকে তাকিয়েছিল ওটা। কার দিকে, কেন তাকিয়েছে, জানি না। আমি শুধু জানি, এর আগে আর কোনদিন নিচে নামেনি প্রহরী।
আরও জোরে চিৎকার করে উঠল ওটা। চমকে উঠলাম দুজনে।
ওই জানালাটার দিকে তাকিয়েছিল ওটা, হাত তুলে দেখাল নিনা, একমাত্র জানালা যেটা পাহাড়ের এই ঢাল থেকে দেখা যায়। জানালাটা কার ঘরের?
গরম নেই। তাও ঘামতে শুরু করলাম। জবাব দিলাম, আমার!
.
০৩.
দৌড় দিতে গেল নিনা। হাত চেপে ধরলাম ওর।
যেতে দাও, ও বলল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
এক মিনিট, আমি বললাম। কিন্তু শুনল না ও। ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবার দৌড় দিতে যাবে এই সময় মাটিতে পড়ে থাকা চকচকে একটা জিনিস চোখে পড়ল আমার। নিচু হয়ে তুলে নিয়ে বললাম, তোমার সানগ্লাস।