হঠাৎ ধাক্কা খেলাম দেয়ালে। কপাল ঠুকে গেল। হাত বাড়িয়ে দেখে বুঝলাম, সামনে এগোনোর পথ নেই। সরে গেলাম একপাশে। ফোকর পাওয়া গেল একটা। এগোতে গেলাম। কিন্তু সুড়ঙ্গমুখ নয় ওটা। দেয়ালের গায়ে বড় একটা গর্ত। পিছিয়ে এলাম। হাতড়ে হাতড়ে বের করার চেষ্ট করলাম সুড়ঙ্গমুখ। অনেক চেষ্টা করেও পেলাম না। যেটা দিয়ে ঢুকেছি, সেটার মুখও বের করতে পারছি না আর।
অবশ হয়ে গেছে শরীর। পরিশ্রমে হাপাচ্ছি। নাক দিয়ে শিস কেটে বেরোচ্ছে নিঃশ্বাস। একটা দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লাম।
হাল ছেড়ে দিয়েছি। মনে হলো, আর কোনদিন বেরোতে পারব না এই অন্ধকার গোলকধাঁধা থেকে। কেউ জানে না আমি এখানে আছি। কেউ আমাকে উদ্ধার করতে আসবে না।
মনের চোখে দেখতে পাচ্ছি, বাইরে এখন বিকেলের রোদ। নীল আকাশ। সাদা সাদা মেঘ। পাখি গান গাইছে। ওসব আর কোনদিন দেখতে পাব না আমি! ভীষণ কান্না পেতে লাগল।
আরেকটা কথা মনে পড়তে আতঙ্কে সিটিয়ে গেলাম। বাইরে এখনও দিন, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবে না আর আলো। বিকেল শেষ হয়ে যাবে। সূর্য ডুববে। সন্ধ্যা নামবে। সূর্যাস্তের পর পরই বেরোয় কবরের প্রহরী! তারপর কি ঘটবে ভাবতে পারলাম না আর।
ঘাম ঝরছে দরদর করে। ঘাড়ের ঘাম মুছতে গিয়ে হাতে ঠেকল মালাটা। আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল মনে। এমন করে চেপে ধরলাম ওটা যেন ধরার ওপরই নির্ভর করছে আমার বাঁচা-মরা।
.
১২.
বাতাস ভেজা। মাটি ভেজা। বসে থাকতে থাকতে প্যান্টের হিপ ভিজে গেল। দেয়ালে হেলান দিয়ে থেকে শার্টের পিঠও ভিজল। শীত শীত করতে লাগল আমার।
কতক্ষণ ওভাবে বসেছিলাম জানি না। হঠাৎ কানে এল, নাম ধরে ডাকছে। কেউ। গুরুত্ব দিলাম না। খিঁচড়ে গেল বরং মেজাজ। আরও যন্ত্রণা দিতে চাইছে। আমাকে।
বাড়তে লাগল ডাকটা। মনে হলো কাছে এগোচ্ছে।
তারপর আস্তে আস্তে আবার দূরে সরে গেল।
কয়েক মিনিট পর আবার শোনা গেল ডাকটা। আবার এগিয়ে আসছে। জোরাল হচ্ছে শব্দ।
আরও এগোতে চেনা চেনা লাগল স্বরটা। তেতো হয়ে গেল মন। আমার সঙ্গে রসিকতা করছে ভূতটা। চেনা মানুষের কণ্ঠ নকল করে আমাকে ধোকা দিতে চাইছে।
আরও এগিয়ে এল ডাক।
আর সহ্য করতে পারলাম না। চেঁচিয়ে উঠলাম, যা ব্যাটা ভূতের বাচ্চা, ভূত! সর এখান থেকে! যা পারিস করগে আমার!
আরও এগোল কণ্ঠটা। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, রবিন, কোথায় তুমি? কোত্থেকে কথা বলছ?
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। ভুল শুনছি না তো? নিনার কণ্ঠ। নাকি ভূতটাই এসেছে নিনার রূপ ধরে আমাকে জ্বালাতে?
জবাব দিলাম না।
আবার শোনা গেল নিনার চিৎকার, রবিন, জবাব দিচ্ছ না কেন?
চিৎকার করে জবাব দিলাম, নিনা, আমি এখানে! এই যে, এখানে! তুমি কোথায়?
কয়েক সেকেন্ড পর আলো দেখতে পেলাম। এগিয়ে আসছে আলোটা।
উঠে দাঁড়ালাম। আমিও এগোলাম সেদিকে।
মুখের ওপর টর্চের আলো পড়ল আমার। নিনা জিজ্ঞেস করল, এই অবস্থা কেন তোমার?
পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তুমি এলে কি করে?
জবাবে বলল ও, কেন আমি কি রাস্তা চিনি না নাকি?
না, সেকথা বলছি না। তুমি জানলে কি করে আমি এখানে আছি?
তুমি তো আর খেলা দেখলে না, চলে গেলে। আমি খেলা সেরে তোমাদের বাড়ি গেলাম। আন্টি বলল, তুমি দুপুরে খেয়ে সেই যে বেরিয়েছ, আর ফেরোনি। সন্দেহ হলো। কোথায় গেলে? মনে হলো, মৃত্যুপুরীতে চলে যাওনি তো? দৌড়ে বাড়ি গিয়ে একটা টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তোমাকে এখানে খুঁজে বের করতে অনেক কষ্ট হয়েছে আমার।
টর্চটা হাত থেকে পড়ে নষ্ট হয়ে গেল। পথ হারিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে খুঁজে বের করলে কি করে?
মাটি নরম। পায়ের ছাপ বসে গেছে। দেখে দেখে এসেছি। হাতে ওটা কি?
চলো, যেতে যেতে বলছি।
সুড়ঙ্গে চলতে চলতে সব কথা খুলে বললাম নিনাকে। আগের রাতে দেখা জীবন্ত লোকটা গুহার ভেতর কঙ্কাল হয়ে পড়ে আছে শুনে ওর গলা দিয়ে স্বর বেরোতে চাইল না। তাগাদা দিল, জলদি চলো, সূর্য ডোবার আগেই বেরিয়ে যেতে ইবে! ওই লোকটাই কুকুরের মালিক, বোঝা যাচ্ছে। মরে দুটোতেই ভূত হয়েছে।
হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল ও।
পেছন থেকে সাবধান করলাম, সাবধান, যত যাই করো, হাত থেকে টর্চ ফেলো না। তাহলে মরেছি!
আর কোন অঘটন ঘটল না। নিরাপদেই বেরিয়ে এলাম গুহাটায়, যেটা থেকে দুটো সুড়ঙ্গ দুদিকে চলে গেছে। ফিরে তাকালাম। পাথরের বেদিতে বসে নীরবে তেমনি বিকট হাসি হাসছে খুলিটা। ফিসফিস করে বললাম ওটাকে, সালাম, ভূতের রাজা, আর আসছি না এখানে! যত ইচ্ছে ভয় দেখাওগে এখন মানুষকে, আমাদের। আর পাচ্ছ না।
মৃত্যুপুরী থেকে বেরিয়ে এসে হাঁপ ছাড়লাম।
পশ্চিম দিগন্তে নেমে গেছে সূর্য। আড়ালে যেতে বেশি বাকি নেই।
জলদি হাঁটো! তাগাদা দিল নিনা। সূর্য ডোবার আগেই কবর এলাকা থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।
খাড়া পাহাড়টার নিচে যখন নামলাম, সূর্য তখন ডুবে গেছে। তবে আর ভয়। নেই ততটা। প্রহরীর এলাকা পার হয়ে এসেছি আমরা।
এতক্ষণে সহজ হয়ে এল নিনা। আমার হাতের ব্রিফকেসটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি আছে ওটাতে, বলো তো?
না খুললে বোঝা যাবে না। তবে অনুমান করতে পারছি।
কি?
দলিল। ইনডিয়ানদের জায়গার। আর গুহার ভেতরে মরে পড়ে থাকা লোকটা সেই ইনডিয়ান সর্দার, আমি নিশ্চিত।
অবাক হলো নিনা। এ ভাবে হেঁয়ালি করে কথা বলছ কেন? কোন ইনডিয়ান সর্দার?