টর্চের আলো ফেলে খুব সাবধানে এগোতে লাগলাম। ভূতের ভয় তো আছেই, পথ হারানোর ভয়ও আছে। কোথাও কোথাও নিচু হয়ে যাচ্ছে ছাত। সেসব জায়গায় মাথা নুইয়ে ফেলতে হচ্ছে। অসাবধান হলে ঠোকর লাগছে মাথায়। দুপাশ থেকে চেপে এসে কোথাও সরু হয়ে যাচ্ছে পথ। হাঁটার সময় বেরিয়ে থাকা পাথরে ঘষা লাগে।
কিছুদূর এগোনোর পর থমকে দাঁড়ালাম। ফিসফিসে একটা কণ্ঠ কানে আসছে। সেই প্রথম থেকেই। আগের দিনও শুনেছি বলে সেদিন আর গুরুত্ব দিইনি। আমার নাম ধরে ডাকাডাকি।
শব্দটা কোনদিক থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করলাম। কান পাতলে মনে হয়, চতুর্দিকেই হচ্ছে। যেদিকে তাকাই, সেদিক থেকেই আসে। বদ্ধ জায়গায় কিংবা সুড়ঙ্গের মধ্যে বোধহয় কোন রকম কারসাজি করে শব্দ, সেজন্যেই ওরকম লাগে।
কিন্তু এ ভাবে ডাকে কে? দেখা দরকার। কিছুটা সামনে এগিয়ে, কিছুটা পিছিয়ে, এদিক ওদিক আরও দুচারটা উপসুড়ঙ্গে ঢুকে বোঝার চেষ্টা করলাম। হদিস পেলাম না। বেশি ঘোরাঘুরি করতেও সাহস পেলাম না। অগত্যা ডাকে ডাকুক এ রকম একটা মনোভাব নিয়ে আবার ফিরে এলাম মূল সুড়ঙ্গে। এগিয়ে চললাম সামনের দিকে।
সুড়ঙ্গের আরেকটা বড় মোড় ঘুরে অন্যপাশে বেরোতেই দেখি সামনে দেয়াল। রুদ্ধ। আর যাওয়ার পথ নেই। ছোট একটা গুহায় ঢুকে শেষ হয়েছে পথ। প্রথমে দেয়ালগুলোতে আলো ফেললাম, তারপর মেঝেতে।
কি যেন একটা পড়ে আছে।
এগিয়ে গেলাম। একটা পুরানো ব্রিফকেস। ভেতরে কি আছে দেখার কৌতূহল হলো। কিন্তু তালা লাগানো। খুলতে পারলাম না। এখানে ব্রিফকেস ফেলে গেল কে? প্রথমেই মনে এল চোর-ডাকাতের কথা। হয়তো এর মধ্যে দামী অলঙ্কার কিংবা টাকাপয়সা আছে।
নিচু হয়ে হাতল ধরে তুলে নিলাম ওটা। হালকা। টাকা কিংবা অলঙ্কার বোঝাই হলে অনেক ভারী হতো। ঝাঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কি আছে। মৃদু খড়মড় শব্দ হলো। বোঝা গেল না কি আছে। একেবারে খালি নয়, এটুকু বোঝা গেল শুধু।
খোলার চেষ্টা করলাম। তালা লাগানো। চাবি নেই সঙ্গে। ভেঙে খুলতে হবে। বাইরে নিয়ে গিয়ে খুলে দেখব ভেবে রেখে দিলাম হাতে। বাঁ হাতে ব্রিফকেস ঝোলানো, ডান হাতে টর্চ। আর কি আছে গুহায় দেখতে লাগলাম। আমার একপাশে কয়েক হাত দূরে এক দেয়ালের গোড়ায় আলো ফেলতেই স্থির হয়ে গেল হাত। বরফের মত জমে গেলাম যেন। নড়তে পারলাম না। দম নিতে পারলাম না। এমনকি চিৎকারও করতে পারলাম না।
আগের রাতে ঝড়ের সময় যে লোকটাকে দেখেছি, সে পড়ে আছে দেয়ালের নিচে। তেমনি হরিণের চামড়ার পোশাক পরনে। মাথায় পালকের মুকুট।
ভাল করে দেখতে গিয়ে বুঝলাম, লোকটা নয়, তার কঙ্কাল। মাথার চুল সব খসে পড়েনি তখনও। শরীরের কিছু কিছু জায়গায় হাড়ের সঙ্গে চামড়া জড়িয়ে আছে।
টপ করে মাথায় পড়ল কি যেন। এতটাই চমকালাম, পানির ফোঁটা কিনা সেটা ভাবারও সময় হলো না। ঘুরে দৌড় দিতে গেলাম। দেয়ালে বাড়ি লেগে হাত থেকে ছুটে গেল টর্চ। মাটিতে পড়ে নিভে গেল। গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ শুনলাম। গাঢ় অন্ধকার যেন গিলে নিল আমাকে।
উবু হয়ে বসে হাতড়াতে শুরু করলাম।
টুপ করে ঘাড়ে পড়ল কি যেন। চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু না, পানির ফোঁটা। বেয়ে নামতে লাগল নিচের দিকে।
আবার হাতড়াতে শুরু করলাম মেঝেতে।
টর্চটা ঠেকল হাতে। তুলে নিয়ে সুইচ টিপলাম। জুলল না। ঝাঁকি দিলাম। তাও জ্বলল না। নানা ভাবে চেষ্টা শুরু করলাম জ্বালানোর জন্যে। জুলল না ওটা। হাত কাঁপছে। কিছুতেই স্থির রাখতে পারছি না। বুকের মধ্যে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে যেন।
যখন বুঝলাম, কিছুতেই জ্বালতে পারব না, আতঙ্কে অবশ হয়ে আসতে চাইল হাত-পা। এই অন্ধকারে বেরোব কি করে?
আন্দাজে পা বাড়ালাম সামনের দিকে।
কয়েক পা এগোতেই হোঁচট লাগল কিসে যেন। বিচিত্র খটমট শব্দ হলো। অকেজো টর্চটা মাটিতে রেখে নিচু হয়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কিসে হোঁচট খেয়েছি। হাতে লাগল খসখসে, শক্ত কিছু। কঙ্কালের গায়ে হাত দিয়েছি বোঝার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাব। ঘুরে উল্টো দিকে দিলাম দৌড়।
সুড়ঙ্গমুখের কাছের দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। পাগলের মত হাত বাড়িয়ে ফাঁকা জায়গা খুঁজতে লাগলাম। ফাঁকা মানেই সুড়ঙ্গমুখ।
পেয়ে গেলাম ওটা। ছুটতে শুরু করলাম অনুমানের ওপর নির্ভর করে।
অকেজো টর্চটা আর তুলে আনিনি। কঙ্কালের কাছেই রয়ে গেছে। কিন্তু এত কিছুর মাঝেও ব্রিফকেসটা ফেলিনি হাত থেকে।
ছুটছি, ছুটছি, ছুটছি। গায়ে পাথরের ঘষা লাগতে বুঝলাম সুড়ঙ্গের সরু অংশটায় পৌঁছে গেছি। আরও কিছুদুর এগিয়ে মাথায় বাড়ি খেলাম। বুঝলাম, নিচু ছাত। আশা বাড়ল। ঠিকপথেই চলেছি।
ছোটা বন্ধ করে তখন হাঁটতে শুরু করলাম।
হাঁটছি তো হাঁটছিই, পথ আর শেষ হয় না। ঘটনাটা কি? এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়?
আরও প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট হাঁটার পর সন্দেহ হলো, পথ হারাইনি তো?
কথাটা মনে হতেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগল। প্রচণ্ড আতঙ্কে মরিয়া হয়ে ছুটতে শুরু করলাম আবার। দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছি। ঘষা লেগে ছড়ে যাচ্ছে কনুই। নিচু ছাতে ঠোকর খেয়ে মাথায় গোলআলুর মত ফুলে যাচ্ছে। কোন। কিছুরই পরোয়া করছি না। কেবল ছুটছি আর ছুটছি।