কিন্তু জোর পেলাম না মনে। কেবলই চিন্তা হতে থাকল, আচ্ছা, সত্যি কি সূর্যাস্তের আগে বেরোয় না ভূতগুলো? ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা অবশ্য বেরোত না। কিন্তু ওটা তো কল্পিত ভূত। বিশাল কুকুরটার লকলকে লাল জিব, ধারাল দাঁত, হিংস্র চেহারা আর রক্ত পানি করা বিকট চিৎকারের কথা ভেবে দমে গেলাম। আবার ওটার মুখোমুখি হতে হবে ভাবতেই কলজের পানি শুকিয়ে গেল। মনকে সাহস জোগালাম এই ভেবে, দুই দুইবার দেখা হয়েছে ওটার সঙ্গে আমার। ইচ্ছে করলেই ক্ষতি করতে পারত। করেনি। কিংবা করতে পারেনি। এর একটাই কারণ হতে পারে, আমার গলার কালো মালাটা। দুবার যদি রক্ষা করে থাকতে পারে আমাকে ওটা, আরও একবার পারবে।
কবরস্থানে উঠে গেছে যে রাস্তাটা, সেটার গোড়ায় এসে দাঁড়ালাম। দ্বিধা করলাম একবার তারপর যা থাকে কপালে ভেবে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলাম।
পৌঁছে গেলাম ঘাসে ঢাকা সেই আয়তাকার জায়গাটায়। কবরস্থানে। মাঝখানে বিশাল ওকের অন্যপাশে মৃত্যুপুরীর কালো মুখটা যেন হাঁ করে আছে। অপরিচিত নয় আর এখন ওটা। তবু দিনের আলোতেও সেদিকে তাকিয়ে গা ছমছম করে উঠল।
আগেরবারের মতই সম্মান দেখানোর জন্যে কবরস্থান মাড়িয়ে না গিয়ে ওটার ধার ধরে এগোলাম। সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা হতে লাগল আবার–কে যেন আড়াল থেকে আমার ওপর নজর রাখছে। আমার প্রতিটি নড়াচড়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করছে। অদৃশ্য চোখের অধিকারী। চারপাশে তাকালাম। কেউ নেই। কবরস্থানটা একটা ঘাসে ঢাকা মাঠ। তাতে এমন কোন ঝোঁপ বা গাছ নেই যার আড়ালে লুকিয়ে আমার ওপর চোখ রাখবে কেউ। তাহলে কোনখান থেকে রাখছে? সব কি আমার মনের ভুল? কল্পনা? বনের দিকে তাকালাম। আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিল যেন নীরব বনটা। মনে হলো আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসছে। ঘাড়ের পেছনটা শিরশির করতে লাগল।
মৃত্যুপুরীর দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মনের পর্দায় ভেসে উঠল আহত ইনডিয়ান যোদ্ধাদের চেহারা। মৃত্যুর সময় হলে এখানে চলে আসত ওরা। ওই গুহার ভেতরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে কতজন! মনে মনে ঈশ্বরের কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করলাম ওদের জন্যে। ওদের উদ্দেশ্যে জোরে জোরে বললাম, হে অশরীরী বীরেরা, আমি তোমাদের বিরক্ত করতে আসিনি। এসেছি তোমাদের বংশধরদের সাহায্য করতে। তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করে নিতে। আমার গায়েও তোমাদের রক্ত আছে। তাই এই গুহাতে অধিকার আছে আমারও। আমাকে সাহায্য করো তোমরা।
শার্টের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে স্পর্শ করলাম একবার কালো মালাটা + ঢুকে পড়লাম গুহায়।
বাইরের চেয়ে ভেতরে অনেক ঠাণ্ডা। কয়েক পা এগোলাম। কি যেন পড়ল কাঁধে। চমকে গিয়ে পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। আবার পড়ল। ওপর দিকে টর্চের আলো ফেলে দেখি পানির ফোঁটা। কোনও ফাটলে জমা হয়ে আছে বৃষ্টির পানি। ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে সেখান থেকে। নিজেকে বোঝালাম, সব কিছু সহজ ভাবে নাও, রবিন। অল্পতেই যদি এ ভাবে চমকে যাও, কাজ করবে কিভাবে?
মেঝেতে আলো ফেললাম। সুপ হয়ে আছে ধসে পড়া পাথর।
গুহার বাকটার অন্যপাশে চলে গেলাম। পেছনে আড়ালে পড়ে গেল গুহামুখ। বিকেলের রোদেলা আকাশও অদৃশ্য। চারপাশে শুধুই অন্ধকার। পাথর আর দেয়াল, দেয়াল আর পাথর ছাড়া অন্য কিছুই চোখে পড়ল না। ভয় তাড়ানোর জন্যে অন্যমনস্ক হতে চাইলাম। নিনার কথা ভাবলাম। কি করছে এখন ও? নিশ্চয় প্রতিপক্ষের ওপর প্রবল আক্রমণ চালিয়েছে। মাথায় লাল ক্যাপ। চোখের সানগ্লাসটা খুলে রেখেছে। খেলার সময় পরা যায় না।
আলো ফেললাম গুহার দেয়ালে। সুড়ঙ্গমুখ দুটোর ওপর। চ্যাপ্টা পাথরে বসে তেমনি বিকৃত হাসি হাসছে খুলিটা। যেন ব্যঙ্গ করছে আমাকে। ধস নেমে এত পাথর পড়ল, ওটার কিছু হয়নি। অবাক হলাম না। জানতাম, থাকবে ওটা। ফোকর দুটোর দিকে তাকালাম। একটার কাছে চিত হয়ে পড়ে আছে গোল পাথরটা, যেটা দিয়ে মুখ বন্ধ করেছিলাম। হয় আপনাআপনি পড়ে গেছে ওটা, কিংবা ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে কুকুরটা। পাহাড় কেঁপে ওঠায়, ধস নামায় হয়তো ফেলতে সুবিধে হয়েছে ওটার। ভাবলাম, ভূতই যদি হবে, তাহলে পাথর ফেলতে প্রকৃতির সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে কেন? নিজের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা নেই? মাথা চুলকালাম। কি জানি! কত রকম ভূত থাকে। একেক ভূতের একেক ধরনের ক্ষমতা।
আবার তাকালাম খুলিটার দিকে। কালো কোটর দুটোর দিকে তাকিয়ে অস্বস্তিতে ভরে গেল মন। নিনার ধারণাই ঠিক মনে হতে লাগল। ওটাকে ওখানে ইচ্ছে করেই রেখেছিল সেনিকারা, যাতে অনুপ্রবেশকারীরা দেখলে ভয় পায়, সুড়ঙ্গে ঢুকতে সাহস না করে।
আড়াল থেকে কেউ যে লক্ষ করছে আমাকে সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা কিন্তু। আছেই। মনে হচ্ছে আমাকে অনুসরণও করছে ওটা। অশরীরী কিছু? নাকি আমার মতই শরীর আছে ওটার। দেখার জন্যে আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে আলো ফেললাম। নাহ, কেউ নেই। অন্ধকার গুহা। কোন নড়াচড়া চোখে পড়ল না। কোন শব্দ নেই।
আবার ফিরলাম সুড়ঙ্গমুখ দুটোর দিকে। প্রথমে ডানে, তারপর বায়ে। দুটোই খোলা। ভেতরে অন্ধকার। আগের বার নিনার সঙ্গে ঢুকেছিলাম ডানেরটাতে। ওটা দেখা হয়ে গেছে। বায়েরটাতে ঢোকার সিদ্ধান্ত নিলাম।
১১.
ঢুকে যেতে শুরু করলাম সুড়ঙ্গের গভীর থেকে গভীরে। মাটি ভেজা ভেজা। নরম। বাইরের পানি পড়ে ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। সেজন্যেই এই অবস্থা। আগেরটার। চেয়ে অনেক বেশি মোড় আর গলিঘুপচি এটাতে। দুদিকের দেয়ালে আরও অনেক ফোকর দেখা গেল। কোনটা শুধুই গর্ত, কোনটা সুড়ঙ্গের মুখ। এখানে পথ হারালে কিংবা ভুল করে যদি ওগুলোর কোনটাতে ঢুকে পড়ে কেউ, বেরোনো মুশকিল। কোনটা দিয়ে কোনটাতে চলে যাবে, চিহ্ন দিয়ে না রাখতে পারলে শেষে বোঝাই যাবে না।