বেশিক্ষণ খোলা রাখতে পারলাম না চোখ। ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভেঙে গেল বজ্রপাতের শব্দে।
এত জোরে বাজ পড়তে আর শুনিনি। চোখ মেলোম। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তীব্র নীল আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরও এসে পড়ল বিদ্যুতের আলো। দিনের মত আলোকিত হয়ে গেল।
আবার বজ্রপাত। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। জানালায় এত জোরে এসে আঘাত হানতে লাগল, ভয় হলো কাঁচ না ভেঙে যায়। কিন্তু ওটা তো খোলা ছিল? নিশ্চয় আমি ঘুমিয়ে পড়লে মা দেখতে এসেছিল। জানালা খোলা দেখে ঝড়ের কথা ভেবে বন্ধ করে রেখে গেছে। ভাল করেছে। নইলে ঘরের মধ্যে বন্যা বয়ে যেত। আমার পায়ের কাছের জানালাটার ছিটকানি বোধহয় ঠিকমত লাগেনি, বাতাসের ঝাঁপটায় সামান্য ফাঁক হয়ে গেছে পাল্লা। সেখান দিয়ে ফিসফিস করে কে যেন ডাকল, রবিন!
বুকের মধ্যে ধক করে উঠল আমার। পুরুষের কণ্ঠ। কিন্তু বাবার নয়। কার তাহলে?
আবার ডাকল, রবিন?
গায়ের চাদরের ধার খামচে ধরলাম। একটানে নিয়ে এসে ফেললাম বুক থেকে গলার কাছে।
কে ডাকে? ভুল শুনছি না তো?
আবার শোনা গেল ডাক, রবিন! শোনো!
গুহার মধ্যেও আমার নাম ধরে ডাকতে শুনেছি। তবে এ ডাক সেই ডাক নয়। স্বাভাবিক মানুষের কণ্ঠের মত। জানালার ফাঁকটা দিয়ে আসছে।
কোনমতেই বাইরে বেরোব না। ওই মায়াডাককে অগ্রাহ্য করতে না পারলে মারা পড়ব-নিজেকে বোঝালাম। যতই ডাকুক, ঘর থেকে আর বেরোচ্ছি না আমি।
রবিন! কথা শোনো?
ঘর থেকে নাহয় না-ই বেরোলাম, কে ডাকে দেখতে তো অসুবিধে নেই? আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। অন্ধকারে কিছু চোখে পড়ল না।
আবার বিদ্যুৎ চমকাল। বাজ পড়ল বিকট শব্দে।
উঠে বসলাম। বিছানা থেকে না নেমে বাঁকা হয়ে এগিয়ে গেলাম জানালাটার দিকে। হাত দিয়ে দেখলাম, পায়ের কাছটায় বিছানা ভিজে গেছে। জানালা বন্ধ না করলে আরও ভিজবে।
আবার বাজ পড়ল। ভয়াবহ শব্দ। থরথর করে কেঁপে উঠল সবকিছু। বিকট শব্দে কি যেন ভেঙে পড়ল বাইরে। বিদ্যুতের আলোয় এমন একটা দৃশ্য দেখলাম, ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে গেল আমার।
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম লম্বা এক লোককে। জানালার কাছ থেকে মাত্র চার ফুট দূরে। লম্বা চুল ঘাড়ের ওপর নেমে এসেছে। মাথায় পাখির পালকের মুকুট। গায়ে হরিণের চামড়ার হাতে বানানো জ্যাকেট, পরনে একই চামড়ার প্যান্ট। বহুকাল আগের ইনডিয়ান যোদ্ধারা যে রকম পরত। পাশে দাঁড়ানো একটা কালো কুকুর। মৃত্যুপুরীতে যেটাকে দেখেছি।
সোজা আমার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা।
জানালা বন্ধ করব কি, হাঁটু কাঁপতে শুরু করল আমার। জানালার শার্সিটা ধরে না রাখলে উপুড় হয়ে পড়েই যেতাম।
আবার বিদ্যুৎ চমকানোর অপেক্ষায় রইলাম।
চমকাল। আলোকিত করে দিল আমাদের পেছনের আঙিনা। আবার দেখলাম লোকটাকে। দাঁড়িয়ে আছে একই ভঙ্গিতে। কুকুরটারও নড়াচড়া নেই। আমার দিকে তাকিয়ে আছে দুজনেই।
হাত তুলল লোকটা। মনে হলো আমাকে বাইরে যাওয়ার জন্যে ইশারা করল। তারপর আবার অন্ধকার।
আর দেখার অপেক্ষা করলাম না। আমি যেতে না চাইলে কি করবে লোকটা কে জানে! তাড়াতাড়ি জানালার ছিটকানি লাগিয়ে দিয়ে বালিশে মাথা রাখলাম। চাদর টেনে দিলাম মুখের ওপর।
ঘুম নেই আর চোখে। কান পেতে শুনছি বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব।
.
১০.
সকালবেলা বাড়ির চারপাশে ঘুরে দেখলাম। মানুষের পায়ের ছাপ দেখলাম না। কুকুরটারও না। এমনকি আমার জানালার নিচে যেখানে লোকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি সেখানেও কোন ছাপ নেই। সবখানে কাদা। পানি জমে আছে। একটা ম্যাপল গাছের মাথা জ্বলে গেছে। কাণ্ডটা মাঝখান থেকে চিরে দুই টুকরো। একটা অংশ ভেঙে পড়েছে মাটিতে। বাজ পড়েছিল গাছটার মাথায়।
নিনার আসার অপেক্ষায় রইলাম।
কিন্তু দুপুরের পর এল না ও। গেলাম ওর বাড়িতে। ওর মা বললেন, স্কুল থেকে ফেরেনি। গেলাম স্কুলে। দেখি বেজবল খেলছে। মাথায় সেই লাল বেজবল ক্যাপ। আমাকে দেখে হাত নাড়ল। আমিও নাড়লাম। দুই ক্লাসের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। বুঝলাম খেলা শেষ না করে আসতে পারবে না ও। শেষ হতে সময় লাগবে।
ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। খেলা দেখতে ভাল লাগল না। মন জুড়ে। আছে ভূত। চলে এলাম ওখান থেকে।
কিন্তু বাড়ি যেতেও ইচ্ছে করল না। কি করব? পা দুটো যেন ঠেলে নিয়ে চলল পাহাড়ের দিকে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সমস্ত রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে ওই গুহার ভেতর।
ঝলমলে রোদ। আকাশে মেঘের চিহ্নও নেই কোনখানে। হান্টার রিজের পথ বেয়ে ওপরে উঠে চললাম আমি। এই রাস্তা, এই পাহাড়, সব নিনার মুখস্থ। আমার। অতটা চেনা হয়নি, তাই দ্রুত এগোতে পারলাম না।
সঙ্গে নিনা নেই। একা যেতে কেমন যেন লাগছে। মনকে বোঝালামও না আসাতে ভাল হয়েছে। ওর ভাল। কালো গুটির মালা আমি পরেছি, ও নয়। কুকুরটার নজর আমার দিকে। অতএব যা করার আমাকেই করতে হবে। ওকে এ সবে টেনে আনব কেন? মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে?
হারলে ক্রীকের ওপরে চলে গেছে সুর্য। ডুবতে তখনও ঘণ্টা দুয়েক বাকি। সূর্যাস্তের আগে কখনও বেরোয় না কুকুরটা। ওটার মালিক ইনডিয়ান লোকটার ভূতও নিশ্চয় রাতের আগে বেরোবে না। অতএব ওই মুহূর্তে মৃত্যুপুরীতে যাওয়া আমার জন্যে নিরাপদ। আশা করলাম সুড়ঙ্গে ঢুকে তল্লাশি চালিয়ে ভূত বেরোনোর আগেই বাড়ি ফিরে যেতে পারব।