.
০৯.
আকাশের অবস্থা ভাল না, রাতে খাবার টেবিলে বসে মা বলল। ঝড় আসবে আজ রাতে।
আকাশে মেঘ। দেখতে দেখতে ছড়িয়ে পড়ল সেটা। ঢেকে দিল পুরো আকাশ। বিদ্যুৎ চমকাতে আরম্ভ করল। কিন্তু সেসব দিকে আমার তেমন নজর নেই। আমি ভাবছি, কি এমন জিনিস খোয়া গেছে ইনডিয়ানদের, যেটা ফেরত এনে দিতে না পারলে কুকুরটা আমার পিছু ছাড়বে না?
খাচ্ছিস না কেন, রবিন? মা জিজ্ঞেস করল, চিন্তা করছিস নাকি কিছু?
কই, না তো, মাকে দেখানোর জন্যে তাড়াতাড়ি বেশি বেশি করে খাওয়া শুরু করলাম।
কিন্তু কয়েক চামচ গিলেই আবার বন্ধ। গলায় আটকে যেতে লাগল। কুকুরটার কথা ভেবে খাবার নামতে চাইছে না গলা দিয়ে। গুহার ভেতরে ওটার ভয়ঙ্কর চেহারা, গরম দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাস, বড় বড় দাঁত, লাল দুটো জ্বলন্ত চোখ, ওক গাছটাকে ঘিরে ভয়াবহ গর্জন, কিছুতেই দূর করতে পারছি না মন থেকে।
কি করব? কি করে ওটাকে আমার পেছন থেকে খসাব? ভেবে কোন কূলকিনারা করতে পারলাম না। কানে বাজছে শামানের কথা–এমন কিছু করো, যাতে বর্তমান ইনডিয়ানদের উপকার হয়। ওদের জিনিস ফেরত পায়। তাহলেই ওদের পূর্বপুরুষের আত্মা শান্তি পাবে। প্রহরীকে সরিয়ে নেবে তোমার পেছন থেকে।
কি উপকার করব? যদি দেখে কিছু করছি না তো কি করবে কুকুরটা?
কারও উপকার করতে হলে তার কিসের অভাব কিংবা কোন কোন অসুবিধে সেটা আগে জানা দরকার। হাতের চামচটা নামিয়ে রেখে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা, এখান থেকে সেনিকা ইনডিয়ানরা চলে গিয়েছিল কেন, জানো কিছু?
খেতে খেতে মুখ তুলল মা। অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে। হঠাৎ সেনিকাদের ব্যাপারে এই আগ্রহ কেন?
দরকার আছে, মা, বলো না? অনুরোধ করলাম।
বাবার দিকে তাকাল মা। আবার আমার দিকে। গেছে কি আর সাধে? ওদের তাড়ানো হয়েছে।
কারা তাড়িয়েছে?
জবাবটা দিল বাবা, আর কারা? শ্বেতাঙ্গরা। স্পেন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এ সব দেশের লোক। বিদেশী হয়েও এলাকার আসল অধিবাসীদের বের করে দিয়েছে। ইনডিয়ানদের বাপ-দাদার সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছে। জোর করে ওদের জমি দখল করে ওদের কুকুরের মত তাড়িয়েছে। যারা যেতে চায়নি, তাদের নিষ্ঠুরের মত খুন করেছে। এ সব ইতিহাস তো তোমার জানার কথা, রবিন।
কিছু কিছু জানি। সব নয়। আচ্ছা, পাহাড়ের মাথার ওই কবরখানাটার মালিক কে? জিজ্ঞেস করলাম, ইনডিয়ানরা নয়?
ছিল।
এখন?
ওরাই, তবে কবর আর দিতে আসতে পারে না, এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরল বাবা। চিবাতে চিবাতে বলল, এলেই লাঠি নিয়ে তাড়া করে শ্বেতাঙ্গরা।
ওরা আদালতে যায় না কেন? যদ্র জানি ইনডিয়ানদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে আমেরিকান সরকারের। জমির দলিল করে নিলেই তো ভোগদখল করতে পারে।
তাও করেছিল। কিন্তু দলিল করে আনার পর পরই কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে এখানকার সেনিকা সর্দার ব্ল্যাকফায়ার চার্লি টাসক্যানি। দলিলগুলো সব। ছিল তার কাছে। কোথায় যে সে গেছে কেউ জানে না। দলিলগুলোও নিখোঁজ হয়েছে তার সঙ্গে। গুজব আছে, চাঁদনি রাতে হান্টার রিজের মাথায় নাকি ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় লম্বা-চওড়া এক জোয়ান পুরুষকে, সঙ্গে বিশাল এক কালো কুকুর। লোকের ধারণা, ভূত।
তারমানে মরে গেছে?
হয়তো গেছে। নইলে আসে না কেন?
তার ছেলেমেয়ে কেউ নেই?
এক ছেলে ছিল। বাবা নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন পর সেও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। লোকে বলে, তাকে যেতে বাধ্য করেছিল এখানকার কয়েকজন প্রভাবশালী লোক। তারপর একে একে সবাইকে জায়গা ছাড়তে হলো একজন ইনডিয়ানকেও আর টিকতে দেয়া হলো না।
শামান হার্ট গ্যাটলিং বাদে?
ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে নাকি তোমার?
হয়েছে। এতক্ষণে বুঝলাম এত জায়গা থাকতে বনে বাস করে কেন সে। তারমানে খোলা জায়গায় আসতেই দেয়া হয় না।
না, মাথা নাড়ল বাবা। বড় নিষ্ঠুরতা। অমানবিক। যাদের জায়গা, তাদেরই ঠাই নেই, ভোগ করছে অন্য লোক। উড়ে এসে জুড়ে বসা একেই বলে।
চুপচাপ ভাবলাম এক মিনিট। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, বাবা, দলিলগুলো যদি পাওয়া যায়, আবার কি তাদের জায়গায় ফিরে আসতে পারবে ইনডিয়ানরা?
তা পারবে। তখন অন্য কেউ বাধা দিলে পুলিশের সাহায্যও নিতে পারবে। তবে দলিল ছাড়া কিছুই করতে পারবে না।
কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। এক সর্দার নাহয় গেছে, বাকি ইনডিয়ানরা আদালতে গিয়ে দলিলের নকল বের করে আনে না কেন?
ইনডিয়ানরা সাদাসিধা মানুষ। শ্বেতাঙ্গদের আইন-কানুনের জটিলতা, ঘোরপ্যাঁচ কমই বোঝে। ওরা এখনও অপেক্ষা করে আছে বোধহয়, ওদের সর্দার ফিরে আসবে, তৈরি করে দেবে ওদের বহু আশার স্বপ্নভূমি।
কতদিন হলো সর্দার নিখোঁজ হয়েছে?
এই বছর পাঁচেক। আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল বাবা, এত প্রশ্ন কেন? সর্দার আর দলিলগুলোর খোঁজ করছ নাকি?
এখনও করিনি। তবে করব ভাবছি।
আর কিছু না বলে দ্রুত খাওয়া শেষ করে উঠে গেলাম ওখান থেকে। নিজের ঘরে গিয়ে একটা বই বের করলাম। কিন্তু মন বসাতে পারলাম না। তা ছাড়া আগের রাতে ঘুমাতে পারিনি। বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে দুচোখ ভেঙে আসতে লাগল। শুয়ে পড়লাম বিছানায়। কিন্তু এত ক্লান্তি সত্ত্বেও ঘুমাতে ভয় পেলাম। মন বলছে কুকুরটা আসবে সেরাতেও।
ঠিক করলাম, যত যাই ঘটুক, ঘর থেকে বেরোব না। না বেরোলে কোন ক্ষতি করতে পারবে না কুকুরটা।