দীর্ঘ একটা মুহূর্ত আমার মালাটার দিকে তাকিয়ে রইল সে। চোখ দুটো তার কুচকুচে কালো, একেবারে মালার গুটির মত! জিজ্ঞেস করল কোথায় পেলে ওটা?
জানালাম, কে দিয়েছে।
ও বলল, কালো গুটি খুব ক্ষমতাশালী।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, শামানরা কি ওঝা, না কবিরাজ? অনেক যাদু জানে?
ধীরে ধীরে হাসি ফুটল তার মুখে। কুঁচকানো মুখের ভাঁজগুলো গম্ভীর হলো আরও। মেঝেতে বিছানো একটা কম্বলে আসনপিড়ি হয়ে বসল। বলল, যাদু আমি জানি, তবে অনেক নয়, অল্প। ইচ্ছে করলে ওরকম যাদু তুমিও দেখাতে পারো, রবিন মিলফোর্ড। হয়তো আমার চেয়ে বেশিই পারো। কারণ তোমার গলার মালাটার ক্ষমতা অনেক।
সত্যি বলছেন?
সত্যি।
তাহলে আপনি কালো গুটির মালা পরেন না কেন?
নিয়ম অনুযায়ী আমি তো পরতে পারব না কালো গুটি পরে একমাত্র বীর যোদ্ধারা।
আমি তো বীর নই। আমার পরাটা ঠিক হলো কিনা বুঝলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, এই মালা দিয়ে কি ভূত ঠেকানো সম্ভব? কবরের প্রহরীকে বাধা দেয়া যাবে?
কবরের প্রহরীকে বাধা দেয়ার দরকারটা কি তোমার? কোথায় দেখলে ওকে?
মৃত্যুপুরীতে। কাল ওই সুড়ঙ্গে ঢুকেছিলাম আমরা।
মুহূর্তে বদলে গেল শামানের মুখের ভঙ্গি। মৃত্যুপুরীতে ঢুকেছিলে! একবার আমার দিকে একবার নিনার দিকে তাকাতে লাগল সে। তারপর আমার ওপর দৃষ্টি স্থির হলো তার। মৃত্যুপুরী থেকে কেউ বেচে ফিরতে পারে না!
কিন্তু আমরা ফিরেছি, শান্তকণ্ঠে বললাম।
আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টিটা কেমন অদ্ভুতভাবে বদলে গেল তার। নজর নামাল আমার গলার মালাটার দিকে। বলল, বেঁচে ফিরেছ, তার কারণ ওই মালা। ওটাই তোমাকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে। ওটা ছিল এক মহান বীর যোদ্ধার যাকে কবরের প্রহরীও নিশ্চয় সম্মান করে। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে তোমার পূর্বপুরুষ ওই মহান বীরকে স্মরণ করো মনে মনে, তাকে ধন্যবাদ দাও। মালাটা গলায় না থাকলে এখন আর এখানে বসে কথা বলতে পারতে না।
আমি তাকালাম নিনার দিকে। ও আমার দিকে।
শামান জিজ্ঞেস করল, মালাটা কি কখনও ছুঁয়ে দেখেছ?
অবাক হলাম। ছুঁয়ে দেখেছি মানে? এই যে গলায় পরে আছি এটা কি ছোঁয়া নয়?
যখন বিপদে পড়েছ, ভয় পেয়েছ, তখন হাত দিয়ে ছুঁয়েছ?
মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, কাল রাতে কুকুরটা যখন তাড়া করল, তখন ছুঁয়েছি। গাছের ফোকরে যখন বসেছিলাম, আর চারপাশে চক্কর দিচ্ছিল ওটা, তখনও ছুঁয়েছি। বার বার। ভয় পেয়েছিলাম তো খুব, তাই আপনাআপনি হাত উঠে যাচ্ছিল গলার কাছে। এমনকি আগের রাতে আমাদের বাড়ির কাছে যখন গিয়েছিল কুকুরটা, তখনও ছুঁয়েছিলাম। কেন যেন ভয় পেলেই হাত উঠে যায় মালাটার কাছে।
আবার বদলে গেল শামানের চেহারা। বিস্ময় ফুটল কালো চোখে। তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিল প্রহরী?
গিয়েছিল। হঠাৎ একটা চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখতে গেলাম। সেলারে উঁকি দিয়ে দেখতে চাইছিলাম কিসে চিৎকার করেছে। ওই সময় মনে হলো আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওটা। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছি গলা কামড়ে ধরবে। কিন্তু ধরেনি। খানিক পর পেছন ফিরে দেখি কিছু নেই।
আবার কালো মালাটার দিকে নজর গেল শামানের। চুপ করে রইল। তার কালো চোখে উদ্বেগের ছায়া।
প্রহরী এ রকম কেন করল, মিস্টার গ্যাটলিঙ? জানতে চাইল নিনা। হান্টার রিজ থেকে নিচেই নামেনি আর কখনও। রবিনদের বাড়িতে কেন গেল?
কারণ রবিনের ওপর চোখ পড়েছে ওর।
তাকিয়ে রইলাম শামানের দিকে, আমার ওপর? কেন?
আঙুল তুলে মালাটা দেখাল শামান, ওটার জন্যে।
নিজের অজান্তেই হাত উঠে গেল আমার। মালাটা ছুঁয়ে দেখলাম। গায়ের সঙ্গে লেগে থাকায় গরম হয়ে আছে।
মাথা ঝাঁকিয়ে শামান বলল, ওই মালা তোমাকে রক্ষা করছে, রবিন মিলফোর্ড। আবার কবরের প্রহরীকেও আকৃষ্ট করছে। ও জেনে গেছে ওটা আছে তোমার কাছে। কখনও তোমার পিছু ছাড়বে না আর।
ঘাবড়ে গেলাম। তাহলে তো মহামুসিবত! শীত করতে লাগল। মনে হলো। একটা সোয়েটার পরে গেলে ভাল হতো। মগজে যেন কেটে বসে গেল শামানের কথা–কখনও তোমার পিছু ছাড়বে না আর! মালাটা চেপে ধরলাম গলার সঙ্গে। মনে হলো শান্তি পেলাম। ওরকম অনুভূতি আর কখনও হয়নি আমার। মুখ শুকিয়ে গেছে। কথা বলতে কষ্ট হলো। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? আমার কাছে কি চায় ওটা?
মাথা নাড়ল শামান। কি চায় জানি না। শুধু জানি, একটা হাত তুলল সে, যেহেতু কালো মালাটা গলায় পরেই ফেলেছ, ইনডিয়ানদের নিয়ম অনুযায়ী তোমাকে এখন বীর যোদ্ধা বলে প্রমাণ করতে হবে নিজেকে। তা নাহলে ওই প্রহরী ধ্বংস করে ছাড়বে তোমাকে।
আরও শুকিয়ে গেল গলার ভেতরটা। জিজ্ঞেস করলাম, কি করলে বীর যোদ্ধা হব? এখন তো আর লড়াই হয় না যে গিয়ে যুদ্ধ করে আসব।
যুদ্ধ না করেও বীর হওয়া যায়। এমন একটা কাজ করতে হবে তোমাকে, যাতে মৃত যোদ্ধাদের আত্মা শান্তি পায়।
কাজটা কি?
তা তো বলতে পারব না।
কাজটা কি, তাই যদি না জানি, কি করে করব?
দীর্ঘক্ষণ কোন কথা বলল না শামান আমার গলার মালাটার দিকে তাকিয়ে থেকে চুপ করে ভাবতে লাগল তারপর বলল, এমন কিছু করো, যাতে বর্তমান ইনডিয়ানদের উপকার হয়। ওদের জিনিস ফেরত পায়। তাহলেই ওদের পূর্বপুরুষের আত্মা শান্তি পাবে। প্রহরীকে সরিয়ে নেবে তোমার পেছন থেকে।