আর দেখার সাহস পেলাম না। দৌড় দিলাম নিনার পেছনে।
দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবছি, পাথর গলে কি চলে আসতে পারবে ওটা? স্বাভাবিক জানোয়ার হলে হয়তো পারবে না। কিংবা পারতেও পারে। যে বিরাট শরীর, প্রচণ্ড শক্তিতে পাথরটা. ঠেলে ফেলেও দিতে পারে। কিন্তু যদি ভূত হয়, তাহলে পাথর কেন, পাহাড়ও ঠেকাতে পারবে না ওটাকে। ঠিক পার হয়ে চলে। আসবে।
পাথরের অন্যপাশে থেকে গর্জন করছে ওটা। ফিরে তাকালাম পাথরটা তখনও দাঁড়িয়েই আছে। তারপর কানে এল আরেকটা চাপা ভারী শব্দ। আমাদের দুইপাশের দেয়াল, ছাত কাঁপতে শুরু করল। মনে হলো যেন ভূমিকম্প। পায়ের নিচে মাটি কাঁপছে। ছাত থেকে ছোট ছোট পাথর খসে পড়তে লাগল।
গুহামুখের কাছে পৌঁছে গেছে নিনা। আমি তখন অনেক পেছনে। ও যখন ছুটে বেরিয়ে গেল মুখটা দিয়ে, তখনও আমি ভেতরে।
প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ করেই চলেছে কুকুরটা। থরথর করে কাঁপছে মৃত্যুপুরী। ছাত থেকে, চতুর্দিকের দেয়াল থেকে বৃষ্টির মত খসে পড়ছে পাথর। যেন ভূমিধস শুরু হয়েছে। ঘাবড়ে গেলাম ভীষণ। পাহাড়ের দেয়াল ধসে পড়ে আমাকে চাপা দেবে নাকি?
বাইরে থেকে নিনার ডাক শোনা গেল, রবিন, বেরোচ্ছ না কেন এখনও?
হঠাৎ যেন বোমা ফাটল। ফিরে তাকিয়ে দেখি, সুড়ঙ্গমুখের দেয়াল থেকে বিরাট এক পাথর খসে পড়েছে। ওটার ধাক্কায় সরে গেছে গোল পাথরটা। কামানের গোলার মত ছিটকে বেরিয়ে এল বিশাল একটা কালো শরীর। ভয়ানক রাগে গর্জন করতে করতে তেড়ে এল আবার।
ততক্ষণে গুহামুখের কাছে পৌঁছে গেছি আমি। দুই লাফে বেরিয়ে গেলাম। আকাশে তখন তারা ফুটেছে। চিৎকার করে ডাকলাম, নিনা, আই নিনা, কোথায় তুমি?
এই যে এখানে! জবাব এল। গাছের ভেতরে!
একটা মুহূর্তও দেরি করলাম না! দৌড় দিলাম কবরস্থানের মাঝখানে ওকগাছটার দিকে। পেছনে ঘেউ ঘেউ করছে কুকুরটা।
রবিন, ধরে ফেলল তো! জলদি করো না। গুঙিয়ে উঠল নিনা।
গাছের ফোকরটা দেখতে পাচ্ছি। মাটি থেকে বেশ কয়েক হাত ওপরে। প্রাণের তাগিদে মানুষ যে কত অসাধ্য সাধন করে, তার প্রমাণ পেলাম সেদিন। তড়াক করে এক লাফ দিয়ে ধরে ফেললাম ফোকরটার ঠিক নিচের একটা ডাল দোল দিয়ে শরীরটাকে তুলে নিলাম ওপরে। পা ঢুকিয়ে দিলাম ভেতরে। আমাকে টেনে নিল নিনা।
গাছের গায়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল কুকুরটা। আমাদের মত হাত নেই, তাই ডাল ধরতে পারল না। বার কয়েক লাফ দিয়ে চেষ্টা করল, কিন্তু ফোকরটার কাছে পৌঁছতে পারল না।
কি করছে ওটা দেখার কৌতূহল চাপা দিতে পারলাম না। নিনার বাধা অগ্রাহ্য করে আস্তে গলা বাড়িয়ে উঁকি দিলাম।
অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ। সোজা তাকিয়ে আছে ফোকরটার। দিকে। আমি তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল। ভয়ঙ্কর গর্জন করে লাফ দিল আবার।
ঝট করে মাথা নিচু করে ফেললাম।
.
০৮.
মৃত্যুপুরীর কাছে এক প্রাচীন কবরখানায় গাছের ফোকরে বসে রইলাম দুজনে। শুনতে লাগলাম কুকুরটার তর্জন-গর্জন। যখনই ওটার আস্ফালন বেড়ে যায়, গলার কালো গুটির মালাটা চেপে ধরি। এত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতেও কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, জানি না। ঘুম ভাঙলে দেখি ভোর হয়ে গেছে। চলে গেছে কবরের প্রহরী। যাবেই। নিনা বলেছে, সূর্য ডোবার পরে বেরোয় ওটা, আবার সূর্য উঠলে চলে যায়।
বাড়ি ফিরে সত্যি কথাটা বলতে পারলাম না মাকে, ভয়ে। শুনলে রেগে যাবে। জানালাম, রাত কাটিয়েছি নিনাদের বাড়িতে। মাকে না বলে গিয়ে অন্যখানে থাকার জন্যে বকা খেতে হলো। চুপ করে রইলাম।
দুপুরের পর স্কুল শেষ করে নিনা এল। মা দেখার আগেই তাকে ডেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বললাম, রাতে কবরস্থানে থাকার কথা যেন বলে না দেয়।
ও বলল, বলবে না। তার মাকেও সে মিথ্যে বলেছে–রাতে আমাদের বাড়িতে থেকেছে।
আমাকে হার্ব গ্যাটলিঙ নামে একজনের বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছে সে। ওদের পড়শী। নাম শুনেই বুঝলাম, লোকটা ইনডিয়ান।
নিনা জানাল, ও একজন শামান। সেনিকা ইনডিয়ান। শামান মানে জানো তো? ওঝা, কবিরাজ। খুব জ্ঞানী লোক। আমার মনে হয় ও আমাদের সাহায্য করতে পারবে।
গেলাম নিনার সঙ্গে। ওদের বাড়ির পাশে বনের মধ্যে একটা কাঠের বাড়িতে থাকে শামান। সেটার কাছে গিয়ে বন্ধ দরজায় টোকা দিল নিনা। বেরিয়ে এল হালকা-পাতলা একজন মানুষ। লম্বা কালো চুল। গালের চামড়া কুঁচকানো, অংখ্য ভাজ। অনেক বয়েস লোকটার। নিনাকে দেখেই হাসল। ভেতরে যেতে বলল আমাদের।
ওর বাড়িটা ভারি পছন্দ হলো আমার। আমাদেরটার মত অত বড় নয়, মোটে একটা ঘর, বেশ বড়, খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ফায়ারপ্লেসের কাছে গাদা করে রাখা হয়েছে অনেকগুলো কম্বল। তার ওপর বসতে দিল আমাদের। ফায়ারপ্লেসের ওপরে কাঠের দেয়ালে ঝোলানো একটা লাল ওয়ামপাম গুটির মালা আর উজ্জল রঙের পালকে তৈরি ঝলমলে একটা হেডড্রেস, অনেকটা মুকুটের মত জিনিস, ইনডিয়ানরা যা মাথায় দেয়।
শামানের পরনে নীল জিনসের প্যান্ট, গায়ে ফ্লানেলের শার্ট। কিছুটা নিরাশই হলাম পোশাক-আশাক দেখে। আমি ভেবেছিলাম জবরজং কিম্ভুত পোশাক থাকবে। কিন্তু এ তো সাধারণ পোশাক। এই লোক কি সত্যি ভূত তাড়াতে পারবে? তবে শার্টের গলার কাছের বোতাম খুলে ভেতরের জিনিসটা দেখিয়ে দেয়ার পর কেটে গেল নিরাশা। তার গলায়ও একটা ওয়ামপাম গুটির মালা। আমারটার মত শুধু কালো গুটি নয়, নানা রঙের গুটি। মালাটাও অনেক বড়।