আমিও জানি সেটা। অন্ধকারে সুড়ঙ্গে ঢোকা অসম্ভব।
ডানেরটাতেই ঢুকলাম দুজনে। মুখটা এত ছোট, হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হলো। তবে কয়েক হাত এগোনোর পর আস্তে আস্তে চওড়া হয়ে গেল। ছাতও উঠে গেল উঁচুতে। সোজা হয়ে হাঁটা যায়। সুড়ঙ্গে অনেক মোড় আর বাক। ঘোরপ্যাঁচও প্রচুর। কয়েক মিনিট হাঁটার পর নিনা জিজ্ঞেস করল, রবিন, একটা জিনিস লক্ষ করেছ?
এদিক ওদিক তাকালাম, কি?
শব্দটা কমে গেছে।
কোন শব্দ?
তোমাকে যে ডাকছিল?
কান পাতলাম। তাই তো। ঠিকই বলেছে নিনা। খুলিটা দেখার পর শব্দের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। অনেক কমে গেছে শব্দটা। যদিও একনাগাড়ে ডেকে যাচ্ছে তখনও, রঅবিন! রঅবিন! রবিন!
সুড়ঙ্গের ভেতরে যতই এগোলাম আরও কমে এল শব্দ।
মনে হলো ভয় অনেকটা কমেছে নিনার। আমারও সাহস ফিরে এসেছে কিছুটা। শব্দ কমছে, তার মানে শব্দের উৎস থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আমরা। কয়েক মিনিটের মধ্যে একেবারেই শোনা গেল না আর ডাকটা। পুরোপুরি নীরব।
কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকালাম। পেছনে হাঁটছে নিনা। আমার দিকে তাকাল ও। আবার ভয় দেখা দিয়েছে চোখের তারায়। ডাকটা শোনার পর চমকে গিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে সয়ে এসেছিল ওটা। একেবারে যখন থেমে গেল, অখণ্ড নীরবতা আবার অস্বস্তি বাড়িয়ে দিল আমাদের। মনে হতে লাগল, শব্দটা থাকলেই যেন ভাল হতো। আমার গা ঘেষে এল নিনা।
সামনে একটা বড় গুহায় বেরিয়ে এলাম আমরা। মেঝেতে টর্চের আলো ফেলেই স্থির হয়ে গেলাম। রাশি রাশি কঙ্কাল। তাকিয়ে রইলাম হাঁ করে। বুঝতে পারলাম, মৃত্যুর সময় হলে ওখানেই গিয়ে বসে থাকত ইনডিয়ানরা।
এত আওয়াজ কোরো না, ফিসফিস করে বললাম ওকে।
আওয়াজ কে করছে?
জুতো ঘষছ না…?
কথা শেষ করতে পারলাম না। আমার গায়ের ওপর এসে পড়ল নিনা। কিসে করছে… বলতে গেল। কিন্তু ওকেও কথা শেষ করতে দিলাম না আমি। চুপ করে থাকতে বললাম।
হালকা পায়ে হাঁটার শব্দ কানে আসছে।
আমার কানে কানে বলল নিনা, আমাদের সামনে থেকে আসছে!
যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার উল্টো দিকে গুহার দেয়ালে আরেকটা ফোকর। সুড়ঙ্গমুখ। তার ভেতরে হচ্ছে শব্দটা।
কান পাতলাম। এগিয়ে আসছে। পায়ের শব্দ, সন্দেহ নেই, কিন্তু শব্দটা যেন কেমন?
বুঝে ফেললাম। ওই শব্দ আমার পরিচিত। মানুষের পায়ের নয়। রাতের বেলা সেদিন আমাদের ঘরের কাছে শুনেছি।
নিনা! ফিসফিসিয়ে বলার কথা ভুলে গিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। আমি জানি ওটা কিসের শব্দ। গত রাতে শুনেছি! ওটা…
ভূত! নিনাও চিৎকার করে উঠল।
কে যে আগে দৌড় দিল, মনে নেই। শুধু মনে আছে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ঝেড়ে দৌড় দিয়েছি আমরা পেছন ফিরে।
দৌড়াচ্ছি, দৌড়াচ্ছি, দৌড়াচ্ছি। ভূতটাও আসছে আমাদের পিছু পিছু।
আরও জোরে দৌড়াতে লাগলাম। আগে আগে ছুটছে নিনা। দৌড়ের রেকর্ড ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেন ও। কিন্তু তাতেও কুকুরটার সঙ্গে কুলাতে পারছে । আমাদের তাড়া করে না। নিশ্চয় আমাদের গন্ধ পেয়ে বুঝেছে আমরা সুড়ঙ্গে ঢুকেছি। ধরতে আসছে তাই।
জলদি, রবিন, আরও জোরে! চিৎকার করে তাগাদা দিল নিনা। ওই যে সুড়ঙ্গমুখ!
এত জোরে হাঁপাতে লাগলাম মনে হলো বুকটা ফেটে যাবে। আর কত জোরে ছুটব? সামনে বেশি দূরে নেই আর সুড়ঙ্গমুখ। মাথায় ঠোকর খেলাম। নিচু হয়ে গেছে ছাত। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে কুকুরের মত ছুটলাম।
খোলা মুখটা দিয়ে বেরিয়ে গেল নিনা। লাফিয়ে সোজা হয়ে উঠে দৌড় দিল গুহামুখের দিকে। ওখানে পৌঁছতে পারলেও লাভ হবে না। বাইরে নিশ্চয় এখন রাত। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটাও বেরোবে। যদি না থেমে বাইরেও আমাদের তাড়া করে? পারব না ওটার সঙ্গে। সহজেই ধরে ফেলবে। ওটাকে ঠেকাতে চাইলে আটকাতে হবে। আর সেটা গুহার বাইরে গিয়ে হবে না। যা করার ভেতরে থাকতেই করতে হবে। কিন্তু কি করব?
গোল পাথরটার দিকে তাকিয়ে একটা বুদ্ধি এল আমার মাথায়। ডাক দিলাম, নিনা।
থামার একবিন্দু ইচ্ছে নেই ওর, তবু ফিরে তাকাল। ওকে কাছে আসতে বলে একধার থেকে ঠেলতে আরম্ভ করলাম পাথরটা।
কি করছ? চিৎকার করে বলল নিনা। জলদি এসো! ওটা আমাদের ধরে ফেলবে!
পাথর দিয়ে সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ করে দেব। বেরোতে না পারলে আর ধরবে কি করে?
কুকুরটার নিঃশ্বাসের শব্দও কানে আসছে তখন। নিনাকে বললাম, চলে এসেছে ওটা। এসো, হাত লাগাও, আমাকে সাহায্য করো।
সেও এসে ঠেলতে শুরু করল। নড়ে উঠল পাথরটা। আরেকটু…আর একটু…তাহলেই বন্ধ হয়ে যাবে সুড়ঙ্গমুখ। ঠেলতে থাকলাম প্রাণপণে।
চলে এসেছে তো! ককিয়ে উঠে পাথর ছেড়ে দিয়ে আবার দৌড় মারল নিনা।
জোরে এক ঠেলা মেরে গড়িয়ে দিলাম পাথরটা। সুড়ঙ্গমুখে বসে গিয়ে আটকে দিল ফোকরটা।
আরে এসো না! কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে আবার চিৎকার করে ডাকল নিনা।
কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। সামান্য একটু ফাঁক রয়ে গেছে সুড়ঙ্গমুখে। সেটা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলাম। দুর্গন্ধ মেশানো গরম নিঃশ্বাস এসে যেন ধাক্কা মারল নাকেমুখে। জ্বলজ্বলে দুটো চোখ সোজা তাকিয়ে আছে আমার চোখের দিকে। হাঁ করা মুখে বড় বড় ধারাল দাঁত। পাথরের জন্যে আটকা পড়েছে দেখে এত জোরে হাঁক ছাড়ল, মনে হলো কানের পর্দা ফেটে যাবে আমার। অন্যপাশের সুড়ঙ্গে প্রতিধ্বনি তুলল সেই চিৎকার।