তোমার একার দোষ না, জিনা বলল। দোষ আমাদের সবারই। এতটা পথ আমাদের অনুসরণ করে আসবে, কে ভাবতে পেরেছিল? তবে আমি তেমন কাউকে কিন্তু দেখিনি পথে, যাকে সন্দেহ করা যায়।
আমিও না, মুসা বলল।
কিশোর কিছু বলছে না। চুপ করে ভাবছে। তার মনে পড়ছে এখন, মোটর সাইকেলের ইঞ্জিনের শব্দ শুনেছিল, যখন সাইকেল রেখে দোকানে ঢুকছে ওরা, তখন। না না, ওরা যখন দোকানের ভেতরে ঢুকে গেছে, তখন।
নিশ্চয় চোরটা, চিন্তিত ভঙ্গিতে যেন নিজেকেই কথাটা বলল সে। একটা গাধা আমি! ছাগল! কেন পাত্তা দিলাম না!
গালাগাল করার কারণ আছে। সব সময় এতটা বেখেয়াল হয় না। সেজন্যেই এতগুলো জটিল রহস্যের সমাধান করতে পেরেছে। ভালুকটা চুরি যাওয়ায় একটা মূল্যবান সূত্র হারাল। চোরকে কাছে পাওয়ার জন্যে এটা একটা টোপ ছিল।
এবার কি করব? জিনার জিজ্ঞাসা।
কি আর। পুলিশের কাছে যাব, রবিন বলল। জিনিসটা তো চুরিই হয়েছে, নাকি? জিনিস চুরি গেলে পুলিশের কাছেই যেতে হয়।
পুলিশের কাছে? মুসা যুক্তি দেখাল। গিয়ে কি বলব ওদেরকে? পঞ্চাশ পেন্স দামের একটা খেলনা চুরি গেছে? হেসে খুন হয়ে যাবে না।
হবে না, গম্ভীর হয়ে বলল রবিন। যদি ওদেরকে বোঝাতে পারি, ভালুকটা কত দামী। আর নকশাটা দেখাই ওদের।
কিন্তু এখনই নকশাটার কথা পুলিশকে বলতে যাব না আমরা, কিশোর বলল। একবার দিলে আবার কবে ফেরত পাব, কোনদিন পাব কিনা, ঠিকঠিকানা নেই। ব্যাপারটাকে ওরা সিরিয়াসলি নিলে অবশ্য আমার কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু নেবে তো না।
গ্রহণযোগ্য তেমন কোন যুক্তি অবশ্য দেখতে পারল না সে। তবে সেজন্যে চাপাচাপিও করল না কেউ। ওদেরও তেমন ইচ্ছে নেই পুলিশকে দেয়ার। হাজার হোক, রহস্যটা ওদের। ওরাই এটা খুঁচিয়ে বের করেছে। নিজে নিজে সমাধান করতে পারলে মজাটা ষোলো আনা। তবে সেটা করার কোন উপায় আপাতত দেখতে পাচ্ছে না।
পথের ওপর দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা নিয়ে কয়েক মিনিট আলোচনা করল ওরা। তারপর সাইকেল নিয়ে আবার রওনা হলো।
চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেল কিশোর। বলল, এই, শোনো, একটা বুদ্ধি করেছি! আমাদের সাথে চোরের সম্পর্ক এখনও কাটেনি। ভালুকটা নিয়ে গেছে একটা বিশেষ কারণে। নিশ্চয় এখন পেট কাটা হচ্ছে ওটার। ভেতরের জিনিসটা বের করার জন্যে। সকালে আমরা যা করেছিলাম।
তাতে কি? বুঝতে পারছে না মুসা।
কেটে কিছু পাবে না ওর ভেতরে, তুলা ছাড়া। অবাক হবে। পরীক্ষা করতে বসবে তখন। নতুন করে সেলাই করা হয়েছে যে, দেখতে পাবে।
তাতেই বা কি?
কেন, বুঝতে পারছ না? উত্তেজিত হয়ে উঠেছে কিশোর। নকশাটা পাবে না। বুঝে ফেলবে, ওটা আমাদের হাতে পড়েছে!
হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। আবার আমাদের পিছে লাগবে তখন। ভালুকের ভেতরে যে জিনিসটা পেয়েছি, সেটা কেড়ে নেয়ার জন্যে। কিংবা চুরি করার জন্যে। এইবার আর চোখের আড়াল করব না আমরা ওকে। কড়া নজর রাখব।
তবে কিশোরকে এতটা খুশি লাগল না। ভুরু কুঁচকে ফেলেছে। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, টোপটা কোথায় কিভাবে পাতব? ও জানছে না কোথায় রেখেছি আমরা নকশাটা। পেতে হলে পুরো গোবেল ভিলা আতিপাতি করে খুঁজতে হবে তাকে। সেটা করতে যাবে বলে মনে হয় না। সহজ উপায় একটাই আছে…
ঠিক! বুঝে ফেলেছে জিনা। আমাদের একজনকে তুলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে! জোর করে কথা বের করবে মুখ থেকে!
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল মুসার। কাছছাড়া হব না আমরা। কোনমতেই আলাদা হব না। আর রাফির মত একটা কুকুর পাহারায় রয়েছে আমাদের। তুলে নিয়ে যাওয়া কি মুখের কথা? অত সহজ না।
এমনও হতে পারে, রবিন বলল। শুরুতে ওসব কিছুই না করে অন্যভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করবে আমাদের সঙ্গে। এই যেমন টেলিফোন, কিংবা চিঠি।
তা না হয় করল, কিশোর বলল। কিন্তু আমরা তো দিতে চাইব না। তখন বাধ্য করবে কিভাবে? তবে একটা কথা ঠিক, কোন না কোনভাবে যোগাযোগের। চেষ্টা করবেই। তখন আমাদের কাজ হবে, বুদ্ধির খেলায় তাকে পরাজিত করা।
সেই চেষ্টাই করা হবে, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল চারজনে। তারপর অনেকটা হালকা মন নিয়ে ফিরে চলল গোবেল ভিলায়।
*
দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে ওরা কিছু একটা ঘটার। ঘটল না। সেদিন তো নয়ই, পরের দিনও না। নকশারও সমাধান হলো না। অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারল না কিছু।
তার পরদিন এত উজ্জ্বল রোদ উঠল, সৈকতে খেলতে বেরিয়ে পড়ল ওরা। সাগর শান্ত। বালি বেশ গরম। গায়ের কোটও খুলে ফেলতে হলো এক সময়।
সৈকতে আর কেউ নেই। যত খুশি চেঁচাতে পারল ওরা, যে ভাবে খুশি ছোটাছুটি করতে পারল। বিরক্ত হওয়ার কেউ নেই, ফলে ওদেরকেও অস্বস্তিতে থাকতে হলো না। সবচেয়ে বেশি লাফাচ্ছে রাফি, চেঁচামেচি করছে। এমন সব অঙ্গভঙ্গি করছে, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে ছেলেমেয়েরা।
খেলায় এতই ব্যস্ত রয়েছে ওরা, মোটর সাইকেলটা আসার শব্দও শুনল না। সৈকতের ওপরের পথে এসে থেমে গেল ওটা।
টের পেল প্রথমে রাফি। পেয়েই খেলা থামিয়ে দিল আচমকা। ওপরের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে চাপা গরগর শুরু করল।
অবাক হলো কিশোর। ঘুরে তাকাল। অপরিচিত লোকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মাত্র কয়েক ফুট দূরে।
.
০৬.
এগিয়ে আসতে লাগল লোকটা। তরুণ বয়েসী। উঁচু গোড়ালি ঢাকা বুট পায়ে। মাথায় হেলমেট, মুখে টেনে দেয়া সামনের স্বচ্ছ অংশ, ফলে চেহারা দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট। গলায় জড়ানো একটা স্কার্ফ।