উড়ে যেতে লাগল যেন সময়। প্রচুর খাওয়া-দাওয়া হলো। সেই সাথে পেল অনেক সুন্দর সুন্দর উপহার। খুব খুশি ওরা। একে অন্যের উপহারের প্রশংসা করল। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে। তারপর সাগরের ধারে বেড়াতে বেরোল।
সারাদিনে এত খেয়েছে, সাগরের তীরে খোলা বাতাসে ঘুরে আসার পরেও খিদে পেল না তেমন। কাজেই হালকা কিছু খেয়ে খেলতে বসে গেল। তারপর ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গেল।
ঘুমানোর আগে মুসার শেষ কথা, কাল আমার কিছু খাওয়া লাগবে না, বুঝলে।
শুধু হুঁ বলতে পারল কিশোর। তার পরেই ঘুম।
কথাটা একেবারেই ভুল বলেছে মুসা। সকালে উঠেই ভীষণ খিদে। প্রচুর খেতে পারল। অন্য তিনজনও কম গেল না। খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়ল। বাগানে ঘোরাঘুরি করল খানিকক্ষণ। শেষে চলল সৈকতে। দুপুরের খাওয়ার সময় আবার যে খিদে সেই খিদে।
সেদিনটাও কেটে গেল খুব দ্রুত। নতুন কিছু ঘটল না।
তার পর দিন সকালে উঠে কেরিআন্টি দেখলেন খাবারে টান পড়েছে। দোকান থেকে আনতে হবে। তালিকা লিখে ছেলেমেয়েদের ডেকে বললেন বাজার থেকে নিয়ে আসতে।
এই যে এগুলো দরকার, বললেন তিনি। ডিম, ফল, সবজি…সব লিখে দিয়েছি। দুটো ঝুড়ি নিয়ে যাও। সাইকেলের স্যাডল ব্যাগে এত কিছু ধরবে না।
সাইকেল নিয়ে রওনা হলো ওরা। সাথে চলল রাফি। আকাশ মেঘলা নয়, বৃষ্টি পড়ছে না, পথঘাটও খটখটে শুকনো। এমন দিনে সাইকেল চালাতে ভাল লাগে ওদের। বাজারে পৌঁছে কেনাকাটাগুলো জিনাই করতে লাগল, আর ছেলেরা বোঝ বইতে লাগল।
রবিন পকেটে হাত দিতেই হাতে ঠেকল খেলনা ভালুকটা। আন্টিকে দিতে ভুলে গেছে। হাতের কাছে পেল যখন বের করে হাতে নিয়ে দেখতে লাগল নেড়েচেড়ে। বোঝার চেষ্টা করল কি এমন মাহাত্ম্য আছে? রাফিকে দেখাল।
রাফি, দেখ। সুন্দরই জিনিসটা, কি বলিস? কি নাম রাখা যায়, বল তো? এক কাজ করি। নীল রঙ যখন, নীল ভালুকই নাম রেখে দিই।
শান্তকণ্ঠে পেছনে বলে উঠল কেউ, বাহ্, খুব সুন্দর ভালুক তো। হাতে নিয়ে দেখতে দেবে?
ফিরে তাকিয়ে রবিন দেখল এক তরুণী মহিলা তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে হাসিমুখে। চোখগুলো কেমন বিষণ্ণ। হাত বাড়িয়ে রেখেছে ভালুকটার জন্যে।
দিল রবিন। চকচক করে উঠল মহিলার চোখ। উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। ভালুকটার শরীর টিপে টিপে দেখছে।
আমাকে দেবে এটা? অনুনয় শুরু করল মহিলা। দাম আমি দিয়ে দেব। যত চাও, দেব। খেলনাটা আমাকে দিয়ে দাও। আমার ছেলের জন্যে। তার খুব অসুখ। বিছানায় পড়ে আছে। এটা পেলে খুব খুশি হবে।
মহিলার এই অনুনয় অবাক করল রবিনকে। মনটা হঠাৎ নরম হয়ে গেল। খেলনাই তো একটা, এতে যদি মহিলার ছেলে খুশি হয়, তোক না। হ্যাঁ বলতে যাবে সে, এই সময় একটা হাত এগিয়ে এল তার কাঁধের ওপর দিয়ে। মহিলার হাত থেকে প্রায় থাবা মেরে কেড়ে নিল ভালুকটা।
.
০৪.
খুবই দুঃখিত আমি, কিশোর বলল ভদ্র কণ্ঠে। কিন্তু এটা অন্য একজনের জন্যে কেনা হয়েছে, ক্রিসমাস প্রেজেন্ট। এই উপহারের মূল্য আপনার জানা আছে। এটা আর কাউকে দেয়া যাবে না। আপনি চাইলে এ রকম ভালুক অনেক কিনতে পারেন, গোবেল বীচ স্টোরে পাওয়া যায়। ওদের কাছে এখন না থাকলেও অর্ডার দিয়ে আনিয়ে নিতে পারবেন।
প্রতিবাদ করার জন্যে মুখ খুলল মহিলা। কিন্তু শোনার অপেক্ষায় থাকল না কিশোর। রবিনকে টেনে নিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল ক্রেতার ভিড়ে।
কাজটা কি ঠিক হলো? রবিন বলল। কি আর এমন জিনিস? মহিলাকে দিয়ে দিলেই হত। তার ছেলেটার খুব অসুখ।
অসুখ না ছাই! বানিয়ে বলেছে। জিনাদের বাড়ি থেকেই আমাদের পিছে লেগেছে। তুমি খেয়াল করোনি। অবাকই লাগছে আমার এখন! আর কত লোক ওই খেলনা ভালুকের ব্যাপারে আগ্রহী!
মানে? চোখ বড় বড় হয়ে গেছে জিনার। ওই মহিলা আমাদের বাড়ি থেকে পিছে লেগেছে?
হ্যাঁ। বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখলাম ছোট একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তার পাশে। আমাদেরকে দেখে স্টার্ট নিল। খুব ধীরে ধীরে আসতে লাগল আমাদের সাইকেলের পিছে। পুরো রাস্তাটা সেকেন্ড গীয়ারে এসেছে। অথচ ইচ্ছে করলেই আমাদের পাশ কাটিয়ে অনেক আগে চলে আসতে পারত। আসেনি। কেন? আমাদেরকে অনুসরণ করছিল বলে। বাজারের কাছাকাছি পৌঁছে তারপর পাশ কাটাল। ওই মহিলাই গাড়িটা চালাচ্ছিল, আমি দেখেছি।
কিন্তু কেন? মুসার প্রশ্ন। তোমার কি মনে হয় এই মহিলাও ভালুক শিকারীদের একজন?
তাই তো মনে হচ্ছে এখন। আরও একটা ব্যাপার, যে চশমাওয়ালা লোকটা সেদিন ডিককে প্রশ্ন করছিল, খবরের কাগজের লোক বলে পরিচয় দিয়েছিল, তাকেও এখন চোরের দলের লোক বলেই মনে হচ্ছে। একটা ব্যাপার খেয়াল করোনি, কটা ভালুক ছিল, কটা চুরি হয়েছে, খালি সে-কথা জিজ্ঞেস করছিল বার বার লোকটা। রবিনের কাছে একটা আছে শুনে কেমন চমকে গিয়েছিল।
কিশোরের কথা শুনে রবিনও অবাক। তাই তো! হা হা, এই একটা ভালুকই নিতে পারেনি চোরেরা। সেজন্যেই এটা নিয়ে যেতে চেয়েছিল মহিলা!
দিয়ে তো দিয়েছিলে আরেকটু হলেই, মুসা বলল। আরেকটা বোকামি করেছ চশমাওয়ালাকে বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দিয়ে। উচিত হয়নি। ওই ব্যাটা সাংবাদিক না কচু। মহিলাকে বলেছে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। আমাদের পিছু নিতে। কোনভাবে ভালুকটা জোগাড় করে নিয়ে যেতে। হয়তো এর জন্যে টাকাও দিয়েছে মহিলাকে।