হালকা মেঘের ভেতরে ঢুকে গেছে আবার চাঁদ। জ্যোৎস্নার উজ্জ্বলতা অনেক কমে গেছে তাতে। সেই আলোয় দেখা গেল একটা আবছা মত ছায়ামূর্তি এগিয়ে। চলেছে, হাতে দুটো পেট্রোলের ক্যান।
ডনের মতই লাগছে! মুসা বলল ফিসফিসিয়ে। পারকার আংকেল আর পুলিশ। অফিসারেরা যে দিকে গেছে, তার উল্টো দিকে যাচ্ছে লোকটা।
কিছু একটা করা দরকার আমাদের! কিশোর বলল।
আবার মনে করিয়ে দিল রবিন, কিন্তু আংকেল তো এখানেই থাকতে বললেন!
তা বলেছেন। কিন্তু আমরা তো তার অবাধ্য হচ্ছি না। ধরা যাক, রাফি কিছুতেই গাড়িতে থাকতে রাজি হলো না। তাকে বের করে দিতে বাধ্য হলাম আমরা। ছাড়া পেয়েই একটা লোকের পেছনে ছুটল সে। আমাদেরকেও যেতে হলো, তাকে ফিরিয়ে আনার জন্যে।
মিথ্যে বলবে?
এখন কাজ উদ্ধার করা দরকার। সত্যি-মিথ্যে নিয়ে ভাবছি না।
দরজা খুলে দিয়ে রাফিকে নির্দেশ দিল সে। এক মুহূর্তও দেরি করল না কুকুরটা। তীরবেগে দৌড় দিল লোকটার পেছনে। সেলারের লোকগুলোর গন্ধ। ভোলেনি সে। ওদেরই একজন তাকে পিটিয়েছিল। জিনাদের বেঁধে রেখেছিল। প্রতিশোধ নেবে সে!
গাড়ি থেকে নেমে রাফির পেছনে ছুটল কিশোর।
এতই দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাটা, কিছুই করার সুযোগ পেল না অন্য তিনজনে। বোকা হয়ে গেল যেন ওরা।
দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল রাফি। কিশোরকে দেখা যাচ্ছে, অস্পষ্ট। দৌড়াচ্ছে। তবে শিগগিরই তাকেও আর দেখা গেল না।
দেখো, মস্ত ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে কিশোর, জিনা বলল। এটা বসে বসে দেখতে পারি না আমরা। চুপ করে থাকা উচিত হবে না।
গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ওরাও।
কি করতে চাও? মুসা জিজ্ঞেস করল।
যাব।
আমিও যাব। রবিন, তুমি বসে থাকো। আমরা না ফিরলে আংকেলকে বলবে।
বসে থাকার ইচ্ছে নেই রবিনের। ওদের সঙ্গে যেতে পারলেই বেশি খুশি হয়। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো গাড়িটা পাহারা দিতেই হবে, বিশেষ করে আংকেল যখন বলে গেছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও চুপ করে গাড়িতে বসে রইল সে।
অনেক ভারী লাগছে ক্যানগুলো। হাত ধরে এসেছে। জিরিয়ে নেয়ার জন্যে ও দুটো নামিয়ে রাখল ডন।
এখনও বহুদূর! মরার বোটটা আরেকটু কাছে হলে কি হত! বিড়বিড় করে গাল দিল সে। আর ওই ব্যাটা মারভিন, নিজে কিছু করবে না! খালি আমাকে হুকুম দেয়! বসে বসে থাকে!
বেজায় ঠাণ্ডা পড়েছে। তার ওপর বোঝা বইতে গিয়ে যেন অবশ হয়ে গেছে আঙুলগুলো। মুখের কাছে এনে ফুঁ দিয়ে গরম করতে লাগল সে। জিরাতে পারল না বেশিক্ষণ। পিঠে এসে লাগল প্রচণ্ড আঘাত। সামলাতে না পেরে উপুড় হয়ে পড়ে গেল সে।
উঠে দাঁড়ানোর আগেই ডান কাঁধে কামড় লাগল। চেঁচাতে শুরু করল ডন।
ছাড়বি না, রাফি, ধরে রাখ! চিৎকার করে বলল কিশোর– আমি আসছি!
মুহূর্ত পরেই পৌঁছে গেল সে। কামড় ছাড়ানোর জন্যে ধস্তাধস্তি করছে ডন। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে। তার বিপদের কথা জানিয়ে দিতে চায় যেন জেটির সবাইকে।
গড়াগড়ি করছে কুকুর আর মানুষ। কিশোর কি করবে ঠিক করতে পারছে না। এই সময় সেখানে পৌঁছে গেল মুসা আর জিনা।
এসেছ! ওদেরকে দেখে খুশি হলো কিশোর। ধরো ব্যাটাকে! আমি একলা পারতাম না। রাফি, ছেড়ে দে!
কামড় ছেড়ে সরে এল রাফি। উঠে বসল ডন। করুণ অবস্থা হয়েছে তার। আতঙ্কিত করে দিয়েছে তাকে অ্যালসেশিয়ানের বাচ্চা। ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। কুকুরটার দিকে। তাকে যখন চেপে ধরল জিনা, মুসা আর কিশোর, বাধা দিল না সে।
চলো, গাড়ির কাছে নিয়ে যাই, কিশোর বলল। কিছু করতে চাইলে রাফি তো আছেই। এবার অ্যায়সা কামড় দিতে বলব, কথা শেষ করল না সে, ইঙ্গিতেই বুঝিয়ে দিল। পুলিশও আছে। ধরে প্যাঁদানি দিলেই সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে পেটের কথা।
উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে জিনা। অনেক বেশি শব্দ করে ফেলেছে। মারভিন আর ইসাবেল এখন বেরিয়ে না এলেই বাঁচি।
ঠিকই বলেছ! একমত হলো কিশোর। জলদি করা দরকার! হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল সে।
কিন্তু পারকার আংকেলরা কোথায় আছেন, কে জানে! অন্ধকারে তাদেরকে খুঁজে বের করব কি ভাবে?
তবে যতই সমস্যা আসুক, একটা না একটা সমাধান করেই ফেলবে কিশোর। উপায়ের অভাব নেই তার বুদ্ধির ভাণ্ডারে। বলল, চলো তো আগে গাড়ির কাছে যাই।
নিরাপদেই গাড়ির কাছে পৌঁছল ওরা। মারভিন বা ইসাবেল কোন বিপদ ঘটাল না। গাড়ির কাছে এসেই হর্ন টিপে ধরল কিশোর। তিনবার লম্বা, তিনবার খাটো, আবার লম্বা, আবার খাটো, এ ভাবে বাজাতে লাগল। এক ধরনের মেসেজ এটা। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার একই ভাবে বাজাল।
বাহ, সত্যি, কিশোর, তোমার তুলনা নেই! উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল মুসা। তিনটে লম্বা, তিনটে খাটো…এ তো এস ও এস। পুলিশ অফিসারেরা শুনলেই বুঝে যাবে কিছু একটা গড়বড় হয়েছে।
উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে গোয়েন্দারা। দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না কিছুতেই। হয়তো কানে যাবে পুলিশের, ছুটেও আসবে হয়তো, কিন্তু সময় মত আসবে তো? মারভিন আর আইরিনকে ধরতে পারবে? ওরা ঘুণাক্ষরেও যদি বুঝতে পারে, ডন ধরা পড়েছে, আসবে না আর। সোজা পালানোর চেষ্টা করবে। ডনের জন্যে নিজেদেরকে বিপদে ফেলতে রাজি হবে না কিছুতেই।
আরেকটা উপায় বের করা দরকার।
বুদ্ধিটা বের করল এবার জিনা।
.
১৪.
ডন, শোনো, জিনা বলল, একটা কাজ করলে বেঁচে যেতে পারো। অন্তত শাস্তি কম করাতে পারো। আমাদেরকে সাহায্য করতে হবে। বলে দাও, তোমার সঙ্গীরা কোথায় আছে, ছবিগুলো কোথায় আছে। পুলিশের কাছে তোমার পক্ষে সুপারিশ করব আমরা। আমার বিশ্বাস, সরকারী উকিলও তাই করবেন।