তারপর শোনা পেল আরেকটা শব্দ। মরচে পড়া কজার ক্যাচকোচ। খুলে যাচ্ছে সেলারের দরজা।
লাগেনি! এবার চেঁচিয়ে উঠল মুসা। এত জোরে টান দিয়েছিল পাল্লাটা, লাগেইনি! আটকায়নি! ফাঁক হয়ে ছিল!
রাফি! রাফি! চেঁচাতে লাগল জিনা।
দরজা ঠেলে ফাঁক করে ঢুকে পড়ল রাফি। তিন লাফে কাছে চলে এল। জিনার গাল চেটে দিল। নাক ঘষতে লাগল মুখে।
আরে ছাড় ছাড়! জিনা বলল। ওসব পরেও করতে পারবি। আগে খোল তো। দড়িটা খোল পারলে।
রাফির বুদ্ধি আছে, ঠিক, কিন্তু হাত নেই। অত সহজে খুলতে সে পারে না। তবু চেষ্টার ত্রুটি করল না। প্রথমে কাপড় কামড়ে ধরে টেনে হিঁচড়ে জিনাকে বের করার চেষ্টা করল। পারল না। পারার কথাও নয়। এত ভারী একটা শরীর নেয় কি করে। ওসব বাদ দিয়ে দড়ি খুলতে পারে কিনা, সেই চেষ্টা করতে বলল তাকে জিনা। শেষে হাতের দড়ি কামড়াতে শুরু করল রাফি। এই কাজটাও সহজ নয়। মাঝে মাঝেই হাল ছেড়ে দেয়। আবার বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে চিবাতে রাজি করাতে হয়। এমনি ভাবে চলল। শেষে জিনা যখন হতাশ হয়ে পড়ল, ভাবল আর হবে না, তখনই কেটে গেল দড়ি।
উল্লাসে চিৎকার করে উঠল সে। খুলে গেছে! খুলে গেছে! ইস, অবশই হয়ে গেছে! নড়াতেও পারছি না! জোরে জোরে বাঁধনের জায়গাগুলো ডলতে লাগল সে। রাফি! লক্ষ্মী ছেলে! কাজের কাজই করেছিস!
হাতের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে এল। পায়ের বাধন খোলার জন্যে দেরি করল না সে। গড়িয়ে চলে এল অন্যদের কাছে। কিশোর মনে করিয়ে দিল ছুরিটার কথা। দড়ি কেটে ফেললে খোলার চেয়ে সহজ হবে। ওর পকেটেই রয়েছে উপহার পাওয়া বহু ফলার ছুরিটা।
ছুরি বের করে তিন গোয়েন্দার দড়ি কেটে ওদের মুক্ত করতে বেশি সময় লাগল না জিনার।
তাগাদা দিল কিশোর। জলদি চলো। চোরগুলোকে ধরে ওদের কাছ থেকে ছবিগুলো আদায় করে নিতে হবে।
সেলার থেকে বেরিয়ে এল ওরা। সদর দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে গেছে। চোরেরা। তবে ঢুকতে অসুবিধে হলেও বেরোতে অসুবিধে নেই। জানালার ছিটকানি খুলে বেরিয়ে এল গোয়েন্দারা।
থানায় যাব? জিজ্ঞেস করল মুসা।
মিডলটনের থানা চিনি না, জিনা বলল। গোবেল বীচ বেশি দুরে না। ওই থানায়ই যেতে পারি। ওখানকার পুলিশও আমাদের চেনে। মিডলটন থেকে অর্ধেক দূরে তো চলেই এসেছি, আর অর্ধেক গেলেই হলো।
হ্যাঁ, একমত হলো কিশোর। তাতে সময়ও বাঁচবে। মিডলটনে গিয়ে থানা খুঁজে বের করতেও তো সময় লাগবে। চলো।
তবে বলা যত সহজ করা ততটা হলো না। ভীষণ ঠাণ্ডা রাত। ঘন মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ। ফলে আলোও নেই। সাইকেল চালাতেও অসুবিধে। চলছে ওরা, চলছেই, তার পরেও পথ ফুরায় না। আস্তে আস্তে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল সবাই। রবিন বলেই ফেলল, অবাক কাণ্ড! এতক্ষণে তো গোবেল বীচে ঢুকে পড়ার কথা!
পথ হারাইনি তো? দুশ্চিন্তাটা প্রকাশ করে ফেলল মুসা। দাঁ
দাঁড়াও তো, কিশোর বলল। একটা সাইনবোর্ড মনে হচ্ছে।
সাইকেল থেকে নামল সবাই। সাইনবোর্ডই। তবে লেখা পড়া গেল না।
চৌরাস্তায় ভুল করেছি, চিন্তিত হয়ে বলল জিনা। আরেক পথে চলে এসেছি ভুল করে। ফিরে গিয়ে খুঁজে বের করা ছাড়া উপায় নেই।
ইস, একটা আলোটালো যদি পেতাম! বলেও সারতে পারল না রবিন, সামনে দেখা গেল হেডলাইট। দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল আলো দুটো। কাছে এসে ব্রেক কষল, টায়ারের আর্তনাদ তুলে থেমে গেল গাড়ি।
পুলিশের পেট্রোল কার। ভেতরে দুজন অফিসার। একজন ইন্সপেক্টর। আরেকজন সার্জেন্ট। টহলে বেরিয়েছে। লোকে পার্টিতে ব্যস্ত। অপরাধগুলো এ সময়ই বেশি হয় রাস্তায়, কারণ নির্জন থাকে পথঘাট। কড়া নজর রেখেছে দুই পুলিশ অফিসার। এত রাতে চোর-ডাকাত আশা করছে তারা, চারটে কিশোর-কিশোরী আর একটা কুকুরকে অবশ্যই নয়। ওদেরকে খুঁজতে যে পুলিশ আসেনি, নিশ্চিত কিশোর। কারণ বাড়ি থেকে বেরিয়েছে ওরা বেশিক্ষণ হয়নি। এত তাড়াতাড়ি খোঁজ পড়ার কথা নয়।
পথ হারানোতে বিশেষ চিন্তিত ছিল না কিশোর। খুঁজে বের করতে সময় হয়তো লাগত, কিন্তু অসম্ভব ছিল না। তবু পুলিশ দেখে হাঁপ ছাড়ল।
ভালই হলো, ভাবল সে। গোবেল বীচে ফেরার পথ বাতলে দিতে পারবে। পুলিশ।
জিজ্ঞেস করার সময় পেল না সে। তার আগেই বেরিয়ে এল দুই পুলিশ অফিসার। কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল একজন, এই, এত রাতে কি করছ এখানে?
ইন্সপেক্টরের কণ্ঠস্বর পছন্দ হলোনা রাফির। গরগর শুরু করল সে।
সরাও ওটাকে! চুপ করাও! ধমক দিয়ে বললেন পুলিশ অফিসার। চেহারাটা তো বিটকেলে!
প্রতিবাদ জানাল জিনা। তার রাফি এত খারাপ হতেই পারে না। কিন্তু মানতে রাজি নয় ইন্সপেক্টর। মেজাজ ভাল নেই তার। রেগে আছে। এই রাতে ডিউটি দিতে ভাল লাগছে না। সবাই বসে বসে বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে নিউ ইয়ারের আনন্দ করবে, আর তাকে ডিউটি দিতে হবে, এটা মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই।
দেখো, ভদ্রভাবে কথা বলো! আবার ধমক দিল সে। আদব-কায়দা শেখোনি নাকি? ভুরু কুঁচকে তাকাল কিশোরের দিকে। আমার প্রশ্নের জবাব কিন্তু দাওনি। এত রাতে এখানে কি করছ?
গোবেল বীচে যাচ্ছি, জবাবটা দিল জিনা।
বানিয়ে বলার আর জায়গা পাওনি! গোবেল বীচ কি উল্টোদিকে নাকি?
পথ ভুল করেছি। সেটা যখন বুঝলাম, আপনারাও চলে এলেন।
তাই? কোত্থেকে এসেছ?
গোবেল বীচ, জানাল রবিন।