চাবিটা নিয়ে প্রায় দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল মুসা। তালার ফোকরে লাগিয়ে মোচড় দিতেই খুলে গেল। পিংক হাউসে ঢুকতে আর অসুবিধে হলো না ওদের।
ঝগড়া করার শাস্তি, রবিন বলল। ঝগড়াঝাটি না করলে, আর মাথা ঠাণ্ডা রাখলে চাবিটা যে পড়েছে টের পেয়ে যেত।
ভাল হয়েছে, কিশোর বলল। এসো, সেলারে ঢুকি।
নিচে নেমে প্রথমেই হ্যারিকেন দুটো জ্বালানো হলো। শাবল তুলে নিল মুসা। কিশোর বের করল নকশাটা। আসল নকশা। মিনিট দুই পরেই ঘরের পূর্ব দিকের। কোণায় খুঁড়তে আরম্ভ করল ওরা। মাটি ওখানটায় ঝরঝরে, শক্ত, জমাট হয়ে নেই। পালা করে খুঁড়তে লাগল কিশোর আর মুসা। মাঝে মাঝে জিনাও ওদেরকে সাহায্য করল। তবে তার গায়ে ছেলেদের চেয়ে জোর কম, তাই একটানা বেশিক্ষণ খুড়তে পারে না, হাঁপিয়ে যায়।
এক সময় বিড়বিড় করে বলল কিশোর, মাত্র এক ফুট। মুসা, চালিয়ে যাও। হয়ে এল বলে।
অবশেষে ঠং করে কিসে লাগল মুসার শাবল। উৎসাহ পেয়ে আরও তাড়াতাড়ি খুঁড়তে লাগল সে। বেরিয়ে পড়ল একটা টিনের ট্রাঙ্ক।
এরপরে ডালা তোলার পালা। বুকের কাপুনি বেড়ে গেছে ওদের। সবাই ঝুঁকে এল ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে।
কয়েকটা রঙিন ক্যানভাস রোল পাকিয়ে বেঁধে রেখে দেয়া হয়েছে। একটা তুলে সাবধানে মেলে ধরল কিশোর।
ছেলেদের মত শিস দিয়ে উঠল জিনা। চিনি ওটা! ইস্কুলের লাইব্রেরিতে একটা রেফারেন্স বইতে দেখেছি। ওটার নাম উয়োম্যান উইথ ওয়াটার লিলি। সাদা কালো ছবিও দেখেছি এটার, পত্রিকায়। চুরি হওয়ার খবর বেরিয়েছিল যখন, তখন ছেপেছিল।
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। এগুলোই তাহলে চোরাই পেইন্টিং। এখন শুধু গোবেল ভিলায় নিয়ে যাওয়া। তারপর পুলিশের হাতে তুলে দেবেন পারকার আংকেল।
ট্রাঙ্ক, ট্রাঙ্কটা ভীষণ ভারী, কিশোর বলল। বয়ে নিয়ে যেতে পারব না। সবচেয়ে ভাল হয়, বাগানে কোথাও লুকিয়ে রেখে গেলে। তারপর থানায় গিয়ে খবর দিতে পারব।
সেটাই ভাল হবে, হেসে বলল জিনা। এখন এসে ডন আর মারভিন দেখলে কি যে করত…
কি আর করবে? বলে উঠল একটা কণ্ঠ। তোমাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দেবে। কারণ আমাদের কাজটা তোমরাই সেরে দিয়েছ। চাবিটার জন্যে ফিরে এসেছিলাম। পকেটে হাত দিয়ে দেখি, নেই। সেলারে আলো দেখে নামলাম। খুব ব্যস্ত ছিলে তো তোমরা, আমরা যে এসেছি, শোনোনি।
কথা বলছে মারভিন। তার পেছনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে ডন। স্তব্ধ হয়ে গেছে গোয়েন্দারা। যখন ভাবছে, সফল হয়েছে, তখনই এল চরম ব্যর্থতা।
ঝট করে কথাটা মনে পড়ল জিনার। চোরগুলো যে এল, রাফি হুশিয়ার করল কেন? বুকের রক্ত ছলকে উঠল তার। দ্রুত চোখ বোলাল সেলারে। রাফি নেই!
আমার কুকুর! ককিয়ে উঠল সে। তাকে কি করেছেন আপনারা?
হেসে উঠল মারভিন। ওটা ঠিকই শুনতে পেয়েছে, আমরা যে এসেছি। কামড়ানোর চেষ্টাও করেছে। পারেনি। পিটিয়েছি।
কেঁদে ফেলবে যেন জিনা। মেরে ফেলেছেন! আমার রাফিকে মেরে ফেলেছেন! লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল ডনের মুখে খামচি মারার জন্যে। খপ করে তার হাত চেপে ধরল লোকটা। মুসা আর কিশোর জিনাকে সাহায্য করতে এগোল। কিন্তু এক কথাতেই ওদের থামিয়ে দিল মারভিন, খবরদার! এক পা এগোলে মেয়েটার পেটে ছুরি মেরে দিতে বলব ডনকে!
তারপর দ্রুত ঘটতে থাকল ঘটনা। কিছু দড়ি পড়ে রয়েছে সেলারে। তুলে এনে ডন আর মারভিন মিলে বেঁধে ফেলল গোয়েন্দাদেরকে।
যাক, হলো, হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল মারভিন, গোয়েন্দাগিরির শখ খানিকটা মিটবে। চালাকিটা ভালই করেছিলে, আমাদের নকল নকশাটা দিয়ে। তবে শেষ দিকে সন্দেহ হতে আরম্ভ করেছিল আমার। যাই হোক, সব ভালয় ভালয়ই শেষ হলো। তোমাদেরকে হ্যাপি নিউ ইয়ার জানাতে অসুবিধে নেই। হাহ হাহ হাহ! তোমাদেরকে যখন পাবে তোমাদের আত্মীয়-স্বজনরা, তখন সত্যি নতুন বছর এসে যাবে, আর আমরা অনেক দূরে চলে যাব। হয়তো আরও কিছুদিন থাকতাম এখানে, তোমরা যেতে বাধ্য করলে। যাব, কি আর করা। আসল জিনিসটা তো পেয়ে গেলাম। ডন, এসো। হ্যারিকেনগুলো নিয়ে নাও।
দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল সেলারের দরজা। বেরিয়ে গেছে চোরেরা। সাথে করে নিয়ে গেছে দামী ছবিগুলো।
.
১১.
প্রচণ্ড রেগে গেছে কিশোর। ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে রাফির জন্যে। লোকগুলো তাকে এ ভাবে বোকা বানিয়ে গেল, এটা সহ্য করতে পারছে না। গালমন্দ করছে নিজেকে মনে মনে। বেরোতে হবে! চিৎকার করে উঠল সে। বেরোতেই হবে, যে ভাবে হোক!
মুখ আটকে রেখে যায়নি আমাদের, জিনা বলল। তার মানে দরকার মনে করেনি। যদি আমরা গলা ফাটিয়ে চেঁচাইও, আমাদের চিৎকার কারও কানে যাবে না। রাস্তা থেকে অনেক দূরে রয়েছি। আর এত রাতে আসবেও না কেউ। নিউ ইয়ারের পার্টি নিয়ে সবাই ব্যস্ত।
হ্যারিকেনও নিয়ে গেছে! রবিন বলল ভীত কণ্ঠে। কিছু দেখারও উপায় নেই। চাঁদের আলো যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে তাতে যদি কিছু করা যায়!
দেয়ালে ঘষে দড়ি যদি ছিঁড়তে পারি! মুসা বলল। দেখি সেই চেষ্টাই করে। এ ভাবে বাধা থাকতে একটুও ভাল্লাগছে না আমার!
কিন্তু যত ভাবেই ঘষুক, কিছুই করতে পারল না সে।
হঠাৎ কান খাড়া করে ফেলল জিনা। একটা গোঙানি শুনেছে মনে হলো। সেলারে নামার সিঁড়ি থেকে এসেছে শব্দটা।
রাফি! চেঁচিয়ে উঠল সে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মরেনি! আল্লাহ, রাফি মরেনি! বেঁচে আছে! আমার রাফি বেঁচে আছে!