লুকোছাপার ধার দিয়েও গেল না সে। সহকারীদের নিয়ে সোজা নেমে এল। সৈকতে। কেউ যদি ওদের ওপর নজর রেখে থাকে, রাখুকগে।
প্রাস্টিকের একটা ব্যাগে ভরে নকল নকশাটা নিয়ে এসেছে কিশোর। নির্জন। সৈকত। কাউকে চোখে পড়ল না। আগের দিনের মতই। যে পাথরের নিচে ওটা রাখতে বলেছে, সেটার নিচেই রেখে দিল সে। তারপর সবাইকে নিয়ে ফিরে চলল গোবেল ভিলায়।
কিন্তু বাগানের ভেতরে ঢুকে গেটটাও বন্ধ করতে পারল না মুসা, জলদি চলো বলে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। শুরু হলো তার পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশ। দৌড়ে বাগান পেরিয়ে, বাড়ির পাশ দিয়ে ঘুরে চলে এল পেছনের গেটের কাছে। সেটা দিয়ে বেরোলে আরেকটা সরু গলিপথ পড়ে, দুপাশে উঁচু বালির পাড়। পথটা দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে একেবারে পাড়ের কিনারে এসে না দাঁড়ালে দেখা যায় না।
বেশ ঘুরে গেছে পথটা। তবু ওটা দিয়ে সৈকতে যাওয়ার রাস্তায় উঠতে কয়েক মিনিটের বেশি লাগল না।
লুকাব কোথায়? জানতে চাইল রবিন।
বাস স্টপেজের পাশে ছোট একটা ছাউনি আছে, রাস্তা দিয়ে কিছুদূর গেলেই পড়ে। সেটা দেখাল কিশোর। ওটার পেছনে। কাল এখানটাতেই কোথাও মোটর সাইকেল ফেলে গিয়েছিল লোকটা।
রাফিকে শান্ত থাকতে বলল সে। বুঝতে পারল কুকুরটা। নীরবে চলল ওদের সাথে সাথে। এ রকম খেলা তার জন্যে নতুন নয়, আগেও বহুবার খেলেছে। ব্যাপারটা ভালই লাগে তার। শিক্ষিত কুকুর সে। কিশোরের আদেশ একটুও অমান্য করল না।
অনেকক্ষণ কিছুই ঘটল না। বারোটার বাস এল। থামল না। সোজা চলে গেল গোবেল বীচের দিকে। এই ছাউনিটায় এমনিতে থামে না বাস। কেউ যদি নামতে চায়, তাহলে শুধু থামে। আজ এখানকার কোন যাত্রী নেই। ফলে থামল না।
এবার সতর্ক থাকতে হবে, মুসা বলল। বারোটা বাজে। যে কোন সময় এসে হাজির হতে পারে লোকটা।
হ্যাঁ, মাথা দোলাল জিনা।
ওই যে, হাত তুলল মুসা। একটা মোটর সাইকেল আসছে।
কিন্তু থামল না মোটর সাইকেলটা। চলে গেল। কয়েক মিনিট পর গেল একটা কোচ। তারপর একটা লার। এবং তারপর…
চুপ! নোড়ো না! একটানে জিনাকে ছাউনির আড়ালে নিয়ে এল কিশোর। ওই লোকই!
ছাউনির পেছনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে ওরা। পারলে দেয়ালের সঙ্গে শরীর মিশিয়ে ফেলতে চায়। শোনা যাচ্ছে মোটর সাইকেলের ইঞ্জিনের শব্দ। বাড়ছে… বাড়ছে…থেমে গেল। উঁকি দিতে ভয় পাচ্ছে গোয়েন্দারা। যদি লোকটা দেখে ফেলে? শেষে আর থাকতে পারল না মুসা, মাথা বের করে দিল একপাশ দিয়ে।
হ্যাঁ, মোটর সাইকেল! ফিসফিসিয়ে বলল সে। পথের অন্যপাশে রেখেছে। সৈকতের কিনারে। ওপরে। চলো, দেখি কি করে।
সাবধানে রাস্তা পেরোল ওরা। কোন শব্দ করছে না। রাস্তাটা পেরিয়েই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল কিশোর। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল। এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে চলে এল ঢালের কিনারে।
গলা বাড়িয়ে তাকাতেই দেখল, নেমে গেছে লোকটা। পাথরের দিকে এগোচ্ছে।
নকশাটা তুলতে যাচ্ছে, জানাল কিশোর। জলদি করতে হবে। সময় নেই।
সরে চলে এল চারজনেই। দ্রুত হাতে মোটর সাইকেলের নম্বর লিখতে শুরু করল রবিন। মুসা আর রাফি চুপ করে দেখছে। ক্যারিয়ার বক্স খুঁজছে কিশোর আর জিনা। আশা করছে এমন কোন কিছু পেয়ে যাবে, যেটা চোরকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করবে।
ভাগ্য ওদের পক্ষে। একটা চিঠি পেল জিনা। তাতে নাম-ঠিকানা লেখা রয়েছে। কে পাঠিয়েছে সেটা লেখা থাকলে ভাল হত! বিড়বিড় করল কিশোর। ঠিকানাটা পড়ে ফেলেছে। মিস্টার ডন হারভে। মিডলটন। জায়গাটা গোবেল বীচের কাছেই।
যেখানে পেয়েছিল খামটা আবার সেখানে রেখে দিল জিনা। একেবারে সময়মত।
চাপা ঘাউ করে উঠেছে রাফি। লোক আসছে, বুঝিয়ে দিল।
আসছে! রাফির পর পরই বলে উঠল রবিন। সৈকতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ফিরে আসছে লোকটা!
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওখান থেকে সরে এল ওরা। এমন কিছু করল না যেটা অস্বাভাবিক লাগে।
গোবেল ভিলায় ফিরে এসে আবার মাথা ঘামাতে বসল।
তেমন কিছুই পেলাম না, জিনা বলল। মাঝে মাঝে হতাশার কথা শোনানো। তার স্বভাব। তবে ঠিকই করে। সব সময় আশার কথা শোনালে অনেক সময়। খারাপ হয়।
কে বলল! কথাটা পছন্দ হলো না কিশোরের। অনেক পেয়েছি। এত যে পাব। সেটাই আশা করিনি। মোটর সাইকেলের নম্বর বড়জোর ওটার মালিকের সন্ধান দিত আমাদের। কিন্তু এখন ওই খামের ঠিকানা তার নাম-ধামও জানিয়ে দিল।
খুশি হতে পারল না জিনা। মাথা নাড়ল। কি করে জানছি ওটা ওরই নাম? সে ডন হারভে না-ও হতে পারে। হয়তো চুরি করেছে মোটর সাইকেলটা। কিংবা, চেয়ে এনেছে। চিঠিটা হয়তো মোটর সাইকেলের আসল মালিকের।
অযৌক্তিক কথা বলেনি জিনা। তবু মানতে পারল না কিশোর। জিনা, এত হতাশার কথা বলো কেন! তোমার বরং বলা উচিত মোটর সাইকেল আর ওই খামের নাম-ঠিকানা লোকটারই।
বেশ, না হয় বললাম। তাতে কি?
তাতে আলোচনাটা চালিয়ে যেতে পারি আমরা। অনুমান করে। ভুল হতেই পারে। হলে হবে। তখন আবার নতুন উপায় বের করব। আগেই না না করে সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে বসে থাকলে তো আর কাজ হবে না।
কিশোর ঠিকই বলেছে, জিনার দিকে তাকিয়ে বলল মুসা।
হ্যাঁ, আলোচনা চালানোই উচিত, রবিন বলল। দেখাই যাক না কিছু বেরোয় কিনা।
কিন্তু সেটা আর হলো না। খাবারের ডাক পড়ল। ডাকতে এলেন কেরিআন্টি। ডাইনিং রুমে যেতে হলো ওদের।