লোকটাকে অদ্ভুত লাগছে, বোধহয় মুখ ঠিকমত দেখা না যাওয়াতেই লাগছে ওরকম। লোকটাকে পছন্দ হয়নি রাফির। ভাল লোক হলে এমন রেগে যেত না। সে। তাতে সবাই অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। জিনা আর রবিন কাছাকাছি হয়ে গেল, যেন পরস্পরকে রক্ষা করার জন্যে। মুসার হাতে বল। ছোঁড়ার জন্যে। নিয়েছিল। ধীরে ধীরে নামিয়ে নিল হাতটা। কি করবে বুঝতে পারছে না।
এই যে, এগিয়ে আসছে লোকটা। খেলছ বুঝি? রোদটাও ভাল উঠেছে, না? খেলার মতই।
আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করছে সে, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরই ফাস করে দিল সব। মেকি। তার কথা একটুও ভাল লাগল না ছেলেমেয়েদের।
হ্যাঁ, মুখ গোমড়া করে রেখে জবাব দিল মুসা। ভালই দিন। কিন্তু তাতে কি?
মিষ্টি কথা বলে সুবিধে হবে না বুঝে গেল লোকটা। তাই আর ওসবের মধ্যে গেল না। তার আসল চেহারায় ফিরে এল। কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল, তাতে? কাগজটা কই?।
চুপ হয়ে গেল মুসা। জিনা বলল, কিসের কাগজ?
দেখো, ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা কোরো না। ভাল করেই জানো কিসের কাগজ। নীল খেলনা ভালকটার মধ্যে ছিল।
কিশোর বলল, কি বলছেন কিছুই তো বুঝতে পারছি না। আর ভালুকটাও নেই। কোন শয়তান লোক জানি সাইকেলের স্যাডল ব্যাগ থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে। বিশ্বাস না হলে ওকে জিজ্ঞেস করুন, রবিনকে দেখাল সে। ওর ছিল। হারিয়ে খুব মন খারাপ হয়ে গেছে। বেচারি।
কিশোরের কথার সমর্থনে মাথা ঝকাল রবিন। দুঃখ দুঃখ ভাব ফুটিয়ে তুলল চেহারায়।
কঠিন দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকাল লোকটা, মিথ্যে কথা তো ভালই বলতে পারো। তবে ওসব কেচ্ছা গেলাতে পারবে না আমাকে। খেলনাটা চুরি হয়েছে, বিশ্বাস করছি, কিন্তু নকশাটা নেই ওর মধ্যে। তারমানে তোমাদের হাতেই পড়েছে।
চট করে পরস্পরের দিকে তাকাল মুসা আর কিশোর। বেশি কথা বলে ফেলেছে লোকটা। নিজের পরিচয় জানিয়ে দিয়েছে। সে জানে নকশাটা নেই খেলনার ভেতরে। তার অর্থ হয় সে-ই চুরি করেছে, কিংবা তার কোনও দোস্ত। নকশা বলেছে, শুধু কাগজ বলেনি, সুতরাং ওটা নকশাই। কিশোরেরা আন্দাজ করেছিল বটে ওরকম কিছুই হবে, কিন্তু নিশ্চিত ছিল না। এখন হলো।
যাক, এক চোরের দেখা পাওয়া গেল। এখন খুব বুদ্ধি করে মাথা ঠাণ্ডা রেখে চাল চালতে হবে, যাতে ওদের ফাঁদে ফেলা যায়।
কিন্তু গোলমাল করে দিল রাফি। সে খুব বুদ্ধিমান কুকুর, সন্দেহ নেই, তবে কুকুরের তুলনায় বুদ্ধিমান। মানুষের তুলনায় কিছুই না। মানুষের মত মাথা খাঁটিয়ে, চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করতে পারে না। যা করার সহজাত প্রবৃত্তির বশেই করে ফেলে। এখন তার প্রবৃত্তি বলল, নোকটা খারাপ, তার বন্ধুদেরকে হুমকি দিচ্ছে, ক্ষতি করতে চায়, তার মত একটা কুকুরের উচিত তাকে তাড়ানো।
কাজেই সেই কাজই করে বসল রাফি। আক্রমণ করে বসল লোকটাকে। লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার পা কামড়ে ধরল সে। পায়ে মোটা চামড়ার ভারী বুট থাকায় কামড়টা মাংসে বসল না, বেঁচে গেল লোকটা। তবে ভয় যেমন পেল, রেগে গেল তেমনি।
শয়তান! কুত্তা! চেঁচিয়ে উঠল সে। পকেট থেকে একটা কশ (সীসা ভরা পাইপ) টেনে বের করে জোরে এক বাড়ি মারল রাফির মাথায়। টু শব্দটিও আর করতে পারল না কুকুরটা। বেহুশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। নড়লও না আর।
রাফি! চিৎকার করে উঠল জিনা। হাঁটু গেড়ে বালিতে বসে পড়ল কুকুরটার পাশে। আপনি…আপনি আমার রাফিকে মেরেছেন! পস্তাতে হবে! এর জন্যে পস্তাতে হবে আপনাকে! আমরা আপনাকে ছাড়ব না… ফুঁসতে থাকল সে।
চুপ! ধমক লাগাল লোকটা। তুমিও যদি ওরকম একটা বাড়ি খেতে না চাও, চুপ করে থাকো!
রাগে ফেটে পড়বে যেন মুসা আর জিনা। আগে বাড়ল। লোকটার ওপরে ঝাঁপিয়েই পড়বে বুঝি।
খেঁকিয়ে উঠল লোকটা, এই, থামো! ভাল চাইলে আর এক পা এগোবে না! কশটা মাথার ওপর তুলল সে, বাড়ি মারার ভঙ্গিতে। এখানে খেলতে আসিনি আমি। আবার জিজ্ঞেস করছি। ভালুকের ভেতরে যে নকশাটা পেয়েছ সেটা কোথায়?
একটা কথাও বলল না মুসা, জিনা আর রবিন। কিশোর তো যেন শুনতেই পায়নি। এক জায়গায় পাথরের খাজে জমে রয়েছে পানি। বোধহয় তুষার গলেই হয়েছে। আঁজলা ভরে তুলে এনে ছিটিয়ে দিতে লাগল রাফির নাকেমুখে।
জোরে জোরে নাক টানছে রবিন। তার দিকে ফিরল লোকটা। বলল, এরা তো মুখ খুলবে না। তোমাকেই জিজ্ঞেস করছি। সত্যি সত্যি বলবে। নকশাটা কোথায়?
রাস্তার দিকে তাকাল রবিন। যদি কেউ আসে? কিন্তু কেউ আসছে না। ওদেরকে বাঁচানোর মত কেউ নেই কোথাও। কাঁপা গলায় বলল, আমি…আমি…মানে আমার কাছে নেই।…এখানে নেই আরকি। টা রয়েছে আমার আংকেলের বাড়িতে লুকানো! মনের সমস্ত সাহস এক করে জোর গলায় বলল, কোথায় আছে বললাম, কিন্তু তাতে কোন লাভ হবে না আপনার। গোবেল। ভিলাকে টুকরো টুকরো করে ফেললেও বের করতে পারবেন না। পাবেন না ওটা। এমন জায়গায় লুকানো হয়েছে।
রবিন ভেবেছে এ রকম করে বললেই লোকটা নিরাশ হয়ে চলে যাবে। গেল তো না-ই, তাকে আতঙ্কিত করে দিয়ে হা হা করে হেসে উঠল সে।
হাহ্ হাহ্ হাহ্! হো হো হোহ্! বোকা ছেলে! তুমি কি ভেবেছ আমি আনতে যাব ওটা? এত কষ্ট করব? কক্ষনো না। সেধে গিয়ে ধরা দেব ভেবেছ?
হাসি থামিয়ে দিল হঠাৎ। হ্যাঁ, এখন লক্ষ্মী হয়ে যাও সবাই। ভালয় ভালয় দিয়ে দাও ওটা। কাল পর্যন্ত সময় দিলাম। কাল দুপুর বারোটার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। ওই পাথরটার তলায় চাপা দিয়ে রাখবে।