কি করবে সে? নিজেকে প্রশ্ন করল। কি ব্যাখ্যা এর?
হ্যামলিনদের সঙ্গে তর্ক করছে পুলিশ অফিসারেরা। বিশ্বাস করছে না।
কিন্তু মুসা করছে। তার মনে হচ্ছে পুরো দোষটা তার। তাসের খেলা খেলে এই সর্বনাশ করেছে পড়শীদের।
পাতাবাহারের একটা ঝাড়ের দিকে নজর পড়তেই ধড়াস করে উঠল তার বুক। ঘন ছায়ার ভেতর থেকে আলোয় বেরিয়ে এল একজন লোক।
মিস্টার কাকু-কাকু!
চোখে চোখ আটকে গেল দুজনের। শীতল কুটিতে কঠোর হয়ে আছে কাকু-কাকুর চেহারা।
এক পা পিছিয়ে গেল মুসা। প্রয়োজন হলেই যাতে দৌড় দিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারে।
দ্রুত এগিয়ে এল কাকু-কাকু। লম্বা লম্বা পায়ে। ভেজা ঘাস মাড়িয়ে। পেছনে বাতাসে উড়ছে তার হলুদ বর্ষাতির কানা। বিশাল ভূঁড়ি নাচছে হাঁটার তালে তালে।
কিছু বলবে নাকি আমাকে, ইয়াং ম্যান? স্থির, কঠিন দৃষ্টিতে মুসার দিকে তাকিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলল কাকু-কাকু। আমার হারানো তাসের বাক্সটা সম্পর্কে?
তারমানে কাকু-কাকু জানে সব। তাস খেলা হয়েছে বলেই যে হ্যামলিনদের বাড়িটা ধসে পড়েছে, জানে।
.
০৮.
কাকু-কাকুর কুতকুতে গোল চোখজোড়া যেন লেজার রশ্মির মত এসে বিদ্ধ করতে লাগল মুসার চোখকে। সাদা গোঁফের নিচে ঠোঁট দুটো নড়ছে। বিড়বিড় করে বলছে কিছু। গম্ভীর কুটিতে গভীর ভাঁজ পড়েছে চামড়ায়।
জোরে ঢোক গিলল মুসা। সত্যি কথাটা বলতে পারছে না। ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে তাহলে। বলতে পারছে না তাসগুলো ওদের কাছে আছে।
হ্যামলিনের বাড়িটা ধ্বংসের জন্যে ওরাই দায়ী, সেটাও বলার উপায় নেই। বড় অনুশোচনা হচ্ছে।
কাকু-কাকুর পেছনে দাঁড়িয়ে ঘন ঘন মাথা নাড়ছে পুলিশ অফিসারেরা। প্রতিবেশীরা জটলা করছে এখানে ওখানে। নিচু স্বরে কথা বলছে। সবাইই মোটামুটি অবাক, এটুকু বোঝা যাচ্ছে।
না, আমার কিছু বলার নেই, কাকু-কাকুকে বলে দিল মুসা। গলা কাঁপছে! বুকের মধ্যে এত জোরে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা, মনে হচ্ছে গলার কাছে উঠে চলে আসবে। কাশি দিল সে। বড় করে দম নিল। নাহ, কিছু বলার নেই।
তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে ভেজা পিচ্ছিল ঘাসের ওপর দিয়ে দৌড়ানো শুরু করল।
পালাতে চায়। ব্যাপারটা নিয়ে শান্ত মাথায় ভাবতে চায়। কি করা উচিত বোঝা দরকার।
রবিন কিংবা কিশোরের জন্যে অপেক্ষা করল না সে। ফিরে তাকাল না ওদের দিকে।
নিজের বাড়ির নিরাপত্তার মধ্যে পৌঁছানোর আগে থামলও না। সোজা ওপরতলায় নিজের শোবার ঘরে এসে ঢুকল। দরজা লাগিয়ে দিল।
জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। ঠাণ্ডা ঘামে ভিজে গেছে সারা দেহ। ধপ করে বসে পড়ল বিছানার কিনারে। মাথা ঘুরছে। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে।
চোখ বুজল। চোখের সামনে ভেসে উঠল তাসের বাক্সটা। ওপরে লেখা: ভয়াল তাস!
*
সে-রাতে কাকু-কাকুর স্বপ্ন দেখল সে।
সাদা পোশাক পরে আছে কাকু-কাকু। সাদা সুট, সাদা শার্ট, সাদা টাই। সব সাদা। ওর চুল আর গোঁফের মত সাদা।
হাত তুলল সে। গম্ভীর সম্মোহনী ভাষায় বলল: ভয় পাও, মুসা! ভীষণ ভয়!
তারপর ঘুরে দাঁড়াল দরজার দিকে। ট্রাফিক পুলিশের মত হাত তুলে সঙ্কেত দিতে লাগল।
স্বপ্নের মধ্যেই ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসল মুসা। নিজের বিস্মিত চেহারা নিজেই দেখতে পেল। স্বপ্নে সবই সম্ভব।
দরজার বাইরে ভারী পায়ের শব্দ শোনা গেল। নানা রকম শব্দ। ঘোৎ-ঘোৎ চিৎকার, জোরাল গোঙানি।
জোরে জোরে হাত নাড়তে শুরু করল কাকু-কাকু। মাথাটাকে পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে মুখ ওপরে তুলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। ঝাঁকি খেতে থাকল তার কাঁধ ছোঁয়া চুল।
গটমট করে ঘরে ঢুকল ঝকঝকে ধাতব বর্ম পরা একজন নাইট। ঢোকার সময় তার চওড়া কাঁধ ঢাকা বর্ম বাড়ি খেল দরজার সঙ্গে।
খাইছে!…এই, যান, যান! চিৎকার করে উঠল মুসা।
স্বপ্নের মধ্যেও বুঝতে পারছে সে, স্বপ্ন দেখছে। গলা চিপে ধরেছে যেন ভয়। বর্ম পরা নাইটের পেছন পেছন আরও কতগুলো প্রাণীকে ঢুকতে দেখে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল সে।
গথ আর ক্রেল। লম্বা নাকওয়ালা বামন প্রাণী। মুখোশ পরা নাইট। শুয়োরমাথা মানবদেহী প্রাণী।
অদ্ভূত ভঙ্গিতে পেছনে মাথা ঝাঁকি দিতে দিতে চেঁচাতে শুরু করল প্রাণীগুলো। কোনটা লম্বা ডাক ছাড়ছে, কোনটা গোঙাচ্ছে, কোনটা বা গর্জন করছে জানোয়ারের মত।
এত চিৎকার! এত শব্দ! এত হট্টগোল! কান চেপে ধরল মুসা।
কিন্তু মনে শব্দ ঢোকা কোনমতে আটকাতে পারল না। তার ওপর মারামারি বাধিয়ে দিল প্রাণীগুলো। চেঁচামেচি আর হট্টগোল বেড়ে গেল আরও বহুগুণ।
বড় বড় ছুরি আর তরোয়াল তুলে একে অন্যকে লক্ষ্য করে কোপ মারতে শুরু করল ওরা। ধস্তাধস্তি করছে। বর্মধারীরা বুকের সঙ্গে বুক ঠেকিয়ে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করছে একে অন্যকে। তরোয়ালের আঘাত ঠেকাতে বর্ম বাড়িয়ে ধরছে সামনে।
ধস্তাধস্তি করতে করতে বিছানার ওপর এসে পড়ছে ওরা। তরোয়ানোর আঘাতে পর্দা কেটে যাচ্ছে। ডেস্কে রাখা জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ফেলছে মেঝেতে।
যুদ্ধরত একজন ক্রেল ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গিয়ে জানালার কাঁচের ওপর ফেলল একজন মুখোশধারী নাইটকে। ঝনঝন করে হাজারও টুকরো হয়ে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল কাঁচ। দেয়ালের কাগজ চিরে দিল তরোয়ালের আঘাত।
বেরোন! বেরোন! বেরোন! গানের সুরে চিৎকার করে উঠল মুসা।
বেরোল না ওরা।
বেরোন! বেরোন! বেরোন! আবার চিৎকার করে উঠল সে। চিৎকার করতে করতে জেগে গেল। থরথর করে কাঁপছে। সারা শরীর ঘামে ভেজা। শার্টের পেছনটা ভিজে পিঠের সঙ্গে আটকে গেছে।