তাসগুলো সব উল্টে দেখল সে। কিন্তু ক্রেল আঁকা তাসটা পেল না। বামনটা নিয়ে গেল নাকি?
বেশি তাড়াহুড়া করে ফেলেছি, বিশ্বাস করতে পারছে না সে। নিশ্চয় আছে এখানেই।
সময় নিয়ে প্রতিটি তাস উল্টে দেখল সে। রাজা, মিউট্যান্ট বামন, তিন জেকিল, দুই গথ, মুখোশ পরা নাইট…।
কোথায়? কোথায় তুই? বেরো। বেরো বলছি, আনমনে বলছে আর আছাড় দিয়ে দিয়ে একেকটা করে তাস ফেলছে টেবিলে মুসা।
নেই! অবশেষে দুই বন্ধুর দিকে মুখ তুলে ঘোষণা করল সে। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে ক্রেল-তাসটা।
ভ্রূকুটি করল কিশোর। হাত বাড়াল, আমি দেখি তো একবার।
তাসগুলো তুলতে গিয়ে হাত ফসকে একটা তাস মাটিতে পড়ে গেল।
নিচু হয়ে সেটা তুলে নিল মুসা।
একটা ড্রাগন আঁকা তাস।
বিশাল ড্রাগন। জ্বলন্ত চোখ। মাথাটা ওপরে তোলা। গর্জনের ভঙ্গিতে হাঁ করা মুখে ভয়ঙ্কর দাঁতের সারি। নাক দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে।
তাসটা দুই আঙুলে শক্ত করে চেপে ধরল সে।
কানে এল ভারী পায়ের শব্দ। হল ধরে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে কে যেন।
.
০৭.
খাইছে! ড্রাগন! দম আটকে আসতে চাইল মুসার।
তাসটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। ভয় দেখা গেল রবিনের চোখেও। চোখ বড় বড়। মুখ হা।
পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে গেছে কিশোর।
ড্রাগন আসছে! বিড়বিড় করে বলল মুসা। দরজার দিকে তাকাল।
মুসা? কিসের ড্রাগন? জিজ্ঞেস করল একটা পরিচিত কণ্ঠ।
রান্নাঘরে ঢুকলেন মুসার বাবা-মা। বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে। মিসেস আমানের ভেজা চুল থেকে গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মিস্টার আমানের নীল শার্ট ভিজে লেপ্টে গেছে গায়ের সঙ্গে।
না, কিছু না, , জবাব দিল মুসা। একটা খেলা খেলছি আমরা।
হাত কাঁপছে ওর। টেবিলের কিনার শক্ত করে খামচে ধরে রাখল, যাতে কাপুনিটা মার চোখে না পড়ে।
যাক তবু ভাল, বাড়িতেই আছিস, মা বললেন। আমি তো ভাবলাম হঠাৎ বৃষ্টি নামতে দেখে বেরিয়ে গেছিস বাইরে, ভেজার জন্যে। ঝাড়া দিয়ে পায়ের ভেজা স্যান্ডেল খুলে ফেললেন তিনি।
টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালেন মিস্টার আমান। পাশের বাড়িতে কি হয়েছে জানিস? হই-চই শুনিসনি?
কি অবস্থা! মা বললেন। বেচারা হ্যামলিন…
কি হয়েছে, মা? জানতে চাইল মুসা।
হাত দিয়ে মাথা থেকে বৃষ্টির পানি ঝেড়ে ফেললেন মিস্টার আমান। ও, দেখিসনি। যা দেখে আয়গে অবস্থা। ভয়াবহ।
তোরা শুনিসইনি? ভ্রূকুটি করলেন মিসেস আমান। অবাক করলি আমাকে।
রান্নাঘরের পেছনের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলে বাইরে বেরিয়ে এল। তার পেছনে এল কিশোর আর রবিন।
বৃষ্টি থেমে গেছে। ভারী, কালো মেঘগুলো ছিঁড়তে আরম্ভ করেছে। মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে শেষ বিকেলের সূর্য। ছুঁড়ে দিয়েছে রোদের বর্শা।
ভেজা ঘাস মাড়িয়ে কাঠের বেড়াটার কাছে ছুটে গেল মুসা। হ্যামলিনদের বাড়িটা চোখে পড়তেই দাঁড়িয়ে গেল।
বাড়ি না বলে বলা ভাল বাড়ির অবশিষ্ট।
ধসিয়ে দেয়া হয়েছে।
সমস্ত জানালাগুলো ভাঙা। খড়খড়িগুলো ছড়িয়ে পড়ে আছে ভেজা মাটিতে। ধসে পড়ে গেছে একটা দেয়াল। ভাঙা ইটের ছড়াছড়ি। অর্ধেকটা ছাতও ধসে পড়েছে।
বাড়ির সামনে দিয়ে বেরোনোর রাস্তাটার ধারে পাতাবাহারের বেড়া। ভেঙে, মাড়িয়ে ভর্তা করে ফেলা হয়েছে। পাশের বাগানের ফুলগাছগুলো উপড়ানো। কাদার মধ্যে উল্টে পড়ে আছে ডাকবাক্সটা।
বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে নীরব দর্শকরা। সবাই হ্যামলিনের প্রতিবেশী। দুজন গম্ভীর পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন হ্যামলিন দম্পতি। দুজনেই উত্তেজিত। রাগত ভঙ্গিতে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছেন।
কি হয়েছে? একজন পড়শীকে জিজ্ঞেস করল মুসা। ঝড়ে করল নাকি এ কাণ্ড?।
কি জানি, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে জবাব দিল মহিলা। হ্যামলিনরা বলল, ওদের ওপর নাকি হামলা চালানো হয়েছিল।
চমকে গেল মুসা।
মিস্টার হ্যামলিনের সীমানায় ঢুকল তিন গোয়েন্দা। জানালার কাঁচ মাড়িয়ে তার দিকে এগোনোর সময় তার কণ্ঠ কানে এল ওদের।
কোনও ধরনের সেনাবাহিনী! যেন ঘোরের মধ্যে কথাগুলো বলছেন মিস্টার হ্যামলিন। বিমূঢ় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছেন। ইউনিফর্ম পরা ছিল। মধ্যযুগীয় নাইটদের মত। ভোজবাজির মত উদয় হলো, আবার ভোজবাজির মতই গায়েব।
নাইট! নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না তিন গোয়েন্দা।
মিসেস হ্যামলিন ফোঁপাচ্ছেন। কি ভয়ানক! ঘোড়ার পিঠে চড়ে এসেছিল ওরা। মাথায় লোহার হেলমেট। মুখ দেখতে পাইনি ওদের। ওরা…ওরা… কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি।
গলা জড়িয়ে ধরে স্ত্রীকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন মিস্টার হ্যামলিন।
বাড়ি আক্রমণ করেছিল ওরা, পুলিশকে বললেন তিনি। মনে হলো যেন সিনেমা। শুনলে হয়তো পাগল ভাববেন আমাকে। কিন্তু সত্যি বলছি। ঘোড়ার পিঠে চড়ে নাইটেরা এসে আমাদের বাড়ি আক্রমণ করেছিল।
কুঁকড়ে গেল মুসা। গলা শুকিয়ে গেছে। ঢোক গিলতে পারছে না। পা দুটো। হঠাৎ করেই দুর্বল লাগতে শুরু করল।
সিনেমা নয় এটা। জানে সে।
এটা ওদের খেলার ফল। ভয়ঙ্কর তাসের খেলা।
খেলার মধ্যে সে ওর সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিল প্রতিবেশীর দুর্গ আক্রমণ করতে।
আর হ্যামলিনরা আক্রান্ত হয়েছে একদল ঘোড়সওয়ার হেলমেট পরা নাইটদের দ্বারা।
হঠাৎ করেই দুর্বল লাগতে লাগল মুসার। দুই হাতে মুখ ঢাকল। পেটের ভেতর পাক দিচ্ছে। সেটা থামার অপেক্ষা করতে লাগল।