ও কিছু না, রবিন বলল। গাছের মাথায় আঘাত হানছে বৃষ্টি আর বাতাস। কি সাংঘাতিক ঝড় শুরু হলোরে বাবা! একেবারে হঠাৎ করেই। একফোঁটা মেঘও তো জমতে দেখিনি।
হুঁ, আবার পাশা ফেলো, কিশোর বলল। আরও সৈন্য দরকার তোমার। মাত্র তিনশোজন নাইট নিয়ে একটা দুর্গ দখল করতে পারবে না তুমি।
আবার পাশা, গড়িয়ে দিল মুসা। বাইরের কথা শোনার জন্যে কান পাতল। কানে এল শুধু বাতাসের গর্জন আর বৃষ্টির ফোঁটা আছড়ে পড়ার একটানা শব্দ।
দপ দপ্ করে উঠে কাত হয়ে গেল মোমের শিখা। পাশাগুলো ভাল করে দেখার জন্যে টেবিলের ওপর ঝুঁকে এল তিনজনে।
মুসা পেল দুটো ছক্কা, একটা পাঁচ, একটা এক। আবারও আঠারো পয়েন্ট এবং তিনশো নাইট।
আরও চারখান ছক্কা জোগাড় করতে হবে, হেসে উঠল রবিন। আর পারবে বলে মনে হয় না। দেব নাকি রাজার ওপর জাদুর মায়া ছড়িয়ে?
তোমার দান এখনও আসেনি, কিশোর বলল।
চালো আবার। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। চার ছক্কা উঠেও যেতে পারে। কিশোর বলল। একজন অত্যন্ত শক্তিশালী রাজা বাস করে ওই প্রাসাদে। হাজারের কম নাইট নিয়ে ওর দুর্গ তুমি দখল করতে পারবে না। নাইট কম হলে গথের হাতে মারা পড়বে তুমি।
মারা পড়েই গেছি, বড়ই নিরাশ শোনাল মুসার কণ্ঠ। একসঙ্গে চারটে ছক্কা জীবনেও উঠবে না।
চারটে ছক্কা আছে যখন চারটে পাশায়, না ওঠার কোন যুক্তি নেই, আশ্বাস দিল কিশোর। মারো। যা হবার হবে।
একবার ঝাঁকি দিয়েই পাশাগুলো গড়িয়ে দিল মুসা।
ঠিক চারটে ছক্কা।
ইয়াহু! বলে আবার চিৎকার করে উঠল মুসা। দিলাম রাজার বারোটা বাজিয়ে! লাফিয়ে উঠে দুই হাত ছুঁড়তে শুরু করল সে।
প্রচণ্ড কানফাটা শব্দে ভেঙে পড়ল কি যেন। ক্ষণিকের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেল মুসা।
পরক্ষণে একই সঙ্গে চিৎকার করে উঠল তিনজনে।
কিসের শব্দ? ভয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে রবিনের।
কোন কিছু বিস্ফোরিত হলো বোধহয়, কান পেতে থেকে বিড়বিড় করল কিশোর। গাড়িও অ্যাক্সিডেন্ট করতে পারে।
রাগত কথার শব্দ শোনা গেল।
জোরাল চিৎকার।
তারপর তীক্ষ্ণ আর্তনাদ।
সেই সঙ্গে আবারও চিত্তার। কেউ যেন কাউকে আক্রমণ করে বসল।
পরমুহূর্তে ধাতব জিনিসের ঘষাঘষি, ঠোকাঠুকির প্রচণ্ড শব্দ।
তরোয়াল?
আরও চিৎকার। গোঙানি। আর্তনাদ।
জানালার বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল মুসা। পলকের জন্যে। চোখ সরিয়ে ফেলল পরক্ষণে। যদি কিছু ঘটেই থাকে-কি ঘটছে দেখতে চায় না।
মনে হয় যুদ্ধ হচ্ছে বাইরে, কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল রবিন। উঁচুস্বরে বলতে সাহস পাচ্ছে না।
আ-আমার…আমার ভাল লাগছে না এ সব, মুসা বলল। খেলাটা বন্ধ করা দরকার।
কারও কথার অপেক্ষা না করে তাসগুলো সব একখানে জড় করতে শুরু করল সে। হাত কাঁপছে। সব তাসগুলো জড় করার পর একসঙ্গে ঠেলা মেরে সব। ঢুকিয়ে দিল বাক্সের ভেতর।
বন্ধ করে দিল বাক্সের মুখ।
মুহূর্তে ফিরে এল দিনের আলো।
খাইছে! এতক্ষণ অন্ধকারে থাকার পর তীব্র আলোয় চোখ মিটমিট করতে লাগল মুসা।
কি ঘটছিল এতক্ষণ? বিশ্বাস করতে পারছে না রবিন। গাল চেপে ধরেছে। একহাতে। তাসের বাক্সটা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার গেল কোথায়?
কাকতালীয় ব্যাপার, চোখের সামনে যা ঘটে গেল, সেটাকে অবিশ্বাস করতে পারছে না কিশোরও আর। একটা ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে চাইছে।
পায়ের শব্দ শোনা গেল।
হল ধরে এগিয়ে আসছে। রান্নাঘরের দিকে। দ্রুত।
ঘরে এসে ঢুকল কুৎসিত চেহারার এক বামন-মানব।
.
০৬.
চিৎকার করে উঠল রবিন।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। দুই হাত উদ্যত। বাধা দিতে প্রস্তুত।
লাফ দিয়ে দেয়ালের দিকে সরে গেল মুসা। বুকের মধ্যে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে যেন।
গোল মস্ত মাথাটা পেছনে ঝাঁকি দিয়ে হেসে উঠল বামন-প্রাণীটা। তীক্ষ্ণ, উচ্চকিত স্বর।
কালো কোঁকড়া চুল কাঁধের কাছে নেমে গেছে তার। খাটো করে ছাঁটা কালো দাড়ি। সবুজ চোখের মণিতে বন্য দৃষ্টি। লম্বা পাইপের মত নাক। গায়ে লোম ওঠা কালো উলের ফতুয়া। পরনে কালো চামড়ার প্যান্ট। পায়ে লোম বের হয়ে থাকা চোখামাথা বাদামী চটি।
আমি এখন মুক্ত! আনন্দে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল প্রাণীটা। ছোট ছোট হাত দুটো মাথার ওপর তুলে নাচাতে থাকল। পাখির মত স্বাধীন। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে। অনেক ধন্যবাদ।
এই, শুনুন শুনুন! চিৎকার করে বলল কিশোর।
কিন্তু থামল না বামনটা। আনন্দে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। টান দিয়ে রান্নাঘরের দরজা খুলল। হারিয়ে গেল বাইরের বৃষ্টিতে।
চেয়ারে নেতিয়ে পড়ল রবিন। একহাত দিয়ে গাল চেপে ধরে আছে এখনও। কিশোর নড়ল না। এখনও হাত দুটো উদ্যত। মুঠোবদ্ধ। বাধা দিতে প্রস্তুত।
ঘন ঘন ঢোক গিলে হৃৎপিণ্ডটাকে শান্ত করতে চাইল মুসা।
অবশেষে নীরবতা ভাঙল কিশোর। আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে বিড়বিড় করে বলল, ক্রেল। ওই জীবটা ছিল ক্রেল।
আবার ঢোক গিলল মুসা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু বাইরের কোন কিছু চোখে পড়ল না।
জীবটা দেখতে অবিকল চরিত্রতাসের গায়ে আঁকা ছবির ক্রেলটার মত, রবিন বলল।
তাই, না? তাসের বাক্সটার দিকে তাকাল মুসা। ঠিকই বলেছ। দেখতে ওরকমই।
বাক্সটা তুলে নিয়ে ঝাড়া দিয়ে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিল সে। পাগলের মত খুঁজতে লাগল তাসটা। কোথায় ওটা? কই গেল?