আশা করি সত্যি কথাই বলছ, দাঁতে দাঁত চেপে বলল সে। কারণ এ তাসগুলো খেলার জিনিস নয়।
ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গেল মুসা। কিন্তু ভয়টা চেহারায় প্রকাশ পেতে দিল না। কাকু-কাকুর চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি বলতে চান আপনি? তাসের খেলা
আমি বলতে চাই, ওগুলো খেলনা নয়। ভয়ানক বিপজ্জনক।
আপনি…আপনি আমাদের ভয় দেখাতে এসেছেন, ঠিক না? কোনমতে বলল মুসা।
ভয়? ভয়ের দেখেছ কি? তারপর ফিসফিস করে অদ্ভুত সম্মোহনী কণ্ঠে বলল, ঠিক আছে, ভয় যখন পেতেই চাইছ, পাও ভয়! ভীষণ ভয়!
হলুদ বর্ষাতিটা ভাল করে গায়ের ওপর টেনে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল সে। হারিয়ে গেল প্রবল ঝড়ের মধ্যে।
বরফের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল মুসা। কানে বাজছে কাকু-কাকুর কথাগুলো। পাও ভয়! ভীষণ ভয়! নড়ে উঠল হঠাৎ। তাড়াতাড়ি দরজা লাগিয়ে তালা আটকে দিল।
ফিরে তাকাল কিশোরের দিকে। তাসগুলো টেবিলে দেখতে পেল না। লুকিয়ে ফেলেছে কিশোর। হাতটা টেবিলের নিচ থেকে বের করে আনল আবার সে।
অন্য সময় হলে হেসে ফেলত মুসা। এখন হাসল না। লুকালে কেন?
নইলে চোর ভাবত আমাদের। কোনমতেই বিশ্বাস করানো যেত না।
আমিও এ জন্যেই স্বীকার করিনি। কিন্তু তুমিও কি শুধু এ কারণেই ফেরত দাওনি তাসগুলো?
না, মাথা নাড়ল কিশোর। তাসগুলো আমাকে ভীষণ কৌতূহলী করে তুলেছে। সাধারণ খেলা মনে হচ্ছে না এখন আর। এর শেষ না দেখে আমি ছাড়তে চাই না।
কিন্তু পাও ভয়। ভীষণ ভয়, বলে কি বুঝিয়ে গেল লোকটা? চেয়ারে বসল মুসা। অভিশাপ দিল নাকি?
আরে দূর! অভিশাপ না কচু! খেলো তো…
রবিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই তাসের গাদার সবচেয়ে ওপরের তাসটা তুলে উল্টে ফেলল মুসা।
তাসটার বুক কালো রঙ করা।
আস্তে করে তাসটা রাখল টেবিলে।
মুহূর্তে দপ করে নিভে গেল ঘরের সমস্ত বাতি।
.
০৫.
বাবাগো! বলে চিৎকার দিয়ে আরেকটু হলে চেয়ার থেকেই পড়ে যাচ্ছিল মুসা।
আরি, এমন করছ কেন? অন্ধকারে শোনা গেল রবিনের কণ্ঠ। ঝড়ের সময় এমন বিদ্যুৎ যেতেই পারে।
আ-আমার…তা মনে হয় না, কথা আটকে যাচ্ছে মুসার। বিদ্যুতের শিখা আঁকা একটা তাস তুলে নিলাম। অমনি বিদ্যুৎ চমকানো শুরু করল। এখন একটা কালো রঙ করা তাস তুললাম। আলো চলে গেল। রাতের মত কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেল।
চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। দেয়ালের সুইচবোর্ডটা হাতড়াতে শুরু করল সে। কয়েকবার করে টিপল। খটাখট শব্দ হলো। কিন্তু আলো জ্বলল না।
থামো, মুসা, রবিন বলল। অকারণে ভয় পাচ্ছ। ঝড়ের সময় ইলেকট্রিসিটি যায়ই, আবার বলল সে। তার জন্যে এ রকম মাথা গরম করে ফেলার কিছু নেই।
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, এসো, অন্ধকারেই খেলি। দেখা যাক না কি হয়।
কিন্তু রাজি হলো না মুসা।
ডাইনিং রূমে গিয়ে ঢুকল। টেবিল থেকে মোমবাতি তুলে নিয়ে ফিরে এল। অন্ধকারে দিয়াশলাই বের করতে সময় লাগল। তবে কয়েক মিনিটের মধ্যেই। আবার টেবিলে তাসগুলোর ওপর ঝুঁকে পড়ল ওরা। মোমের কমলা আলোয় লম্বা ছায়া পড়ল রান্নাঘরের টেবিলটাতে।
আবার খেলা শুরু করা যাক, গম্ভীর কণ্ঠে বলল কিশোর। রবিন, একটা কর্মাস তুলে নাও।
একটা তাস টেনে নিল রবিন। মোমের আলোয় তুলে ধরল কি আছে দেখার জন্যে। আড়াআড়ি দুটো তরোয়াল আঁকা। নিচে একটা হেলমেট।
গথ জাদুবলে একদল সৈন্য সৃষ্টি করল এখন, কিশোর বলল। রাজার দুর্গ হামলার মুখে। নিজের দুর্গ থেকে বেরিয়ে গিয়ে রাজাকে পাশের অন্য রাজার আরেকটা দুর্গ দখল করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে।
কি করে করব? জানতে চাইল মুসা।
বাইরে বিকট শব্দে বাজ পড়ল। জানালার কাঁচে আঘাত হানছে প্রবল বৃষ্টির ফোঁটা। বাতাসে কাত হয়ে যাচ্ছে মোমের শিখা। প্রায় নিভু নিভু হয়ে গিয়ে লাফিয়ে সোজা হয়ে যাচ্ছে আবার।
তোমাকেও একদল সৈন্য সৃষ্টি করতে হবে, মুসার প্রশ্নের জবাব দিল কিশোর। চারটে পাশা ঠেলে দিল টেবিলের ওপর দিয়ে। প্রতি ছয় ফোঁটার জন্যে একশো করে নাইট তৈরি হবে তোমার।
পাশাগুলো তুলে নিয়ে হাতের তালুতে রেখে ঝাঁকানো শুরু করল মুসা। কিশোর, নিয়ম-কানুনগুলো কি তুমি বানিয়ে নিচ্ছ ইচ্ছেমত?
না। এ ভাবেই এ খেলা খেলতে হয়। মনে মনে রাখতে হয় হিসেবটা। কঠিনই, টেবিলের ওপর অধৈর্য ভঙ্গিতে টোকা দিতে লাগল কিশোর। কথা না। বলে যা বলছি করে ফেলো না।…এত ঝাঁকানো লাগে নাকি? ফেলো ফেলো, পাশা ফেলো। পর পর তিনবার ফেলতে পারবে। তার বেশি না। এই তিনবারে। তোমাকে কম করে এক হাজার নাইট জোগাড় করতে হবে।
পাশাগুলো টেবিলে গড়িয়ে দিল মুসা। তিনটে চার আর একটা ছক্কা পেল।
মোট আঠারো পয়েন্ট, মোমের আলোয় পাশার ফোঁটাগুলো ভালমত দেখে হিসেব করল কিশোর। তারমানে তিনটে ছক্কার সমান। এবং তারমানে তিনশো নাইট জোগাড় হলো তোমার।
মাত্র তিনশো! হতাশ হলো মুসা। তবে মজা পেতে শুরু করেছে। আরও সাতশো সৈন্য…।
থেমে গেল সে। কথা শোনা যাচ্ছে। বহু মানুষের মিলিত কণ্ঠ। চাপা হাসি। একটা ঘোড়া ডাকল। চিৎকার। চেঁচামেচি।
বাইরে থেকে আসছে নাকি?
ঘুরে জানালার দিকে তাকাল মুসা। অন্ধকারে এমনিতেই কিছু দেখা যায় না। তার ওপর জানালার কাঁচে বৃষ্টির পানির পর্দা। দৃষ্টি ভেদ করে ওপাশে যেতে দিচ্ছে না।
শুনতে পাচ্ছ? ফিসফিস করে বলল সে।