আর দ্বিধা করল না মুসা। চারটে পাশাই তুলে নিয়ে হাতের তালুতে ঝাঁকিয়ে টেবিলের ওপর গড়িয়ে দিল। সবগুলোতেই পাঁচ কিংবা ছক্কা। হাত ওপরে তুলে। ঝাঁকি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে, ইয়াহু! বিরাট ক্ষমতার অধিকারী এখন আমি!
রবিন আর কিশোরও পাশা চালল। দুজনের কারোরই তিনের বেশি উঠল না।
নাহ, গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল কিশোর, রাজাটা সত্যিই শক্তিশালী হয়ে গেল। রবিনের দিকে তাকাল সে। দুজনে একজোট হয়ে রাজার সঙ্গে লাগতে হবে এখন আমাদের। নইলে পারব না।
মুচকি হাসল মুসা। রাজা রাজাই। তাকে দমন করা অত সহজ না।
দেখা যাবে, চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করল কিশোর।
রাজারও ভুলে যাওয়া উচিত না, রবিন বলল, জাদুকরের চেয়ে শক্তিশালী কিছু নেই। যা খুশি করে ফেলতে পারে জাদুকর।
কথার লড়াই বাদ দাও না তোমরা, চেয়ারে হেলান দিল কিশোর। শক্ত হয়ে বসো। খেলাটা অনেকটা পুরানো গল্পের মত। গল্পের তিনটে চরিত্র আমরা। এখন চোখ বোজো। কল্পনা করতে থাকো, প্রাচীন যুগে রয়েছি আমরা। রাজা বাদশাদের যুগে। বনের মধ্যে বাড়ি। বনের কিনারে একটা দুর্গ।
রাজার দুর্গ! আমার! মুসা বলে উঠল।
তার কথায় কান দিল না কিশোর। গম্ভীর ভঙ্গিতে প্রায় ফিসফিস করে বলল, বনটা ভয়ানক বিপজ্জনক। অদ্ভুত সব প্রাণীর বাস ওখানে। মুখোশ পরা নাইট। মিউট্যান্ট যোদ্ধা। ক্রেল। গথ! মর্ড। জেকিল। বিষাক্ত উদ্ভিদ। নিষ্ঠুর শত্রুরা সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ায় বনের মধ্যে।
ভয় পেয়ে গেল মুসা। কিশোর, এমন করে বলছ, আমার গায়ে কাঁটা। দিচ্ছে।
থামল না কিশোর। কর্মসের গাদাটা মুসার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, তাস টানো। হাতে নিয়ে ওল্টাও। এরপর যা ঘটবে সামাল দেয়ার জন্যে তৈরি করো নিজেকে।
কি ঘটবে?
কিশোরের গম্ভীর মুখভঙ্গি, আবেগঘন ভারী কণ্ঠ, কালো চোখের স্থির দৃষ্টি ঘাবড়ে দিল মুসাকে। আগের মত হালকা নেই আর পরিবেশটা। কি জানি কেন মেরুদণ্ডের ভেতরে শিরশির করে উঠল তার।
সবচেয়ে ওপরের তাসটা টেনে নিয়ে উল্টে ফেলল।
হলুদ রঙের একটা মোটা বিদ্যুতের শিখা আঁকা রয়েছে ওতে।
তাসটা টেবিলের ওপর রাখল সে।
সঙ্গে সঙ্গে গুড়গুড় করে মেঘ ডাকল।
জানালার বাইরে বিদ্যুৎ চমকাল।
বাজ পড়ল বিকট শব্দে।
খাইছে! চিৎকার করে উঠল মুসা।
বাইরে তো উজ্জ্বল রোদ। বজ্রপাত হয় কি করে?
ছোঁ মেরে তাসটা তুলে নিল সে।
আবার মেঘের গুড়গুড়। বিদ্যুতের চমক। বজ্রপাত।
বিদ্যুতের আলোয় চোখে পড়ল একটা কুৎসিত, বিকৃত মুখ। বিচিত্র আলোয় সবুজ, কাঁপা কাঁপা দেখাচ্ছে। জানালার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
.
০৪.
চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। ধাক্কা লেগে চেয়ারটা উল্টে পড়ল। মেঝেতে। ঠাস করে শব্দ হলো। আরেকবার চমকে গেল সে।
জানালার বাইরে বাজ পড়ল আবার। কাছেই কোথাও। বাড়ির দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল সে-শব্দ।
থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোয় মুখটাকে দেখা যাচ্ছে এখনও।
কাকু-কাকু!
জানালার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে রেখেছে। গোল কুতকুতে চোখের দৃষ্টি ওদের ওপর স্থির। তারপর হাত তুলে রান্নাঘরের দরজাটা খুলে দিতে ইশারা করল সে।
চিৎকারটা যেন আপনিই বেরিয়ে এল মুসার মুখ থেকে। ও এখানে কি করছে?
ভারী দম নিল। দরজাটা খুলে দিতে এগোল সে।
টান দিয়ে খুলল দরজার পাল্লা। এই সময় প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল আবার। কেঁপে উঠল বাড়িটা। পেছনের সিঁড়িতে মুষলধারে আছড়ে পড়তে দেখল বৃষ্টির ফোঁটা। পেছনের আঙিনার বুড়ো গাছগুলো দমকা বাতাসের ঝাঁপটায় গুঙিয়ে উঠে নুয়ে নুয়ে পড়ছে।
মুহূর্তে এ ভাবে বদলে গেল কি করে আবহাওয়া? অবাক লাগল তার।
বৃষ্টির মধ্যে পিঠ কুঁজো করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল কাকু-কাকু। সাদা চুলগুলো ভিজে লেপ্টে গেছে মাথার সঙ্গে।
হলুদ রঙের একটা বর্ষাতি চাপিয়ে দিয়েছে তার টি-শার্ট ও পাজামার ওপর। বর্ষাতির গায়ে চকচক করছে বৃষ্টির ফোঁটা। চোখের পাতা সরু করে মুসার দিকে তাকাল সে।
আমি জানতাম এ বাড়িতেই থাকো তুমি, খসখসে, চড়া স্বরে কথা বলল কাকু-কাকু। ভেজা গোঁফ জোড়া বিচিত্র ভঙ্গিতে দুলে উঠল ঠোঁটের ওপর।
মুসার কাঁধের ওপর দিয়ে কিশোর আর রবিনের দিকে তাকাল সে। টেবিল থেকে উঠে এসে ওর পাশে দাঁড়াল রবিন।
তোমরাই তখন গ্যারেজে ঢুকেছিলে, তাই না? সন্দিহান দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল কাকু-কাকু। একটা তাসের প্যাকেট খোয়া গেছে ওখান থেকে। কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল সে। কুতকুতে চোখের দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে মুসা আর রবিনের ওপর। তোমরা নিশ্চয় কিছু জানো না। তাই না?
রবিনকে মাথা ঝাঁকাতে দেখল মুসা। বুঝতে পারল সত্যি কথাটা বলে দিতে যাচ্ছে রবিন।
আমরা চোর নই, মিস্টার কাকু-কাকু! রবিন মুখ খোলার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল মুসা। এ কথাটাই তো জিজ্ঞেস করতে এসেছেন?
মোরগের মত মাথা কাত করে একপাশ থেকে তাকাল কাকু-কাকু। সত্যি জানো না?
বললামই তো আমরা চোর নই, মুসা বলল। আমরা আপনার তাস চুরি করিনি।
মাথা ঝাঁকাল কাকু-কাকু। চোয়াল ডলল। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। তার বর্ষাতিতে বাড়ি খেয়ে রান্নাঘরের মেঝেতে এসে পড়ছে পানি।
ঘরের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দিল সে। গলা লম্বা করে তাকাল মুসা আর রবিনের দিকে। মুখের কাছে মুখ চলে এল। পুদিনার গন্ধ তার নিঃশ্বাসে।