খাড়াই বেয়ে ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠে অবশেষে চূড়ায় এসে শেষ হলো।
উঁচু চূড়াটায় দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল তিন গোয়েন্দা। অনেক নিচে মাঠটা চোখে পড়ছে।
তরোয়াল তুলল ক্রেলেরা। এগিয়ে যেতে ইশারা করল বন্দিদের।
আমাদেরকে চূড়া থেকে ফেলে দিতে চায়! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ফিরে তাকাল ক্রেলদের দিকে। চেঁচিয়ে বলতে লাগল, কেন আমাদের ফেলতে চাইছেন? কি করেছি আমরা? ছেড়ে দিন আমাদেরকে। লড়াই করতে আসিনি আমরা।
মুক্তি নেই…মুক্তি নেই…মুক্তি নেই…
তরোয়াল তুলে এগিয়ে এল কয়েকজন ক্রেল।
এগোতে শুরু করল তিন গোয়েন্দা।
চলে এল একেবারে চূড়ার কিনারে।
কিশোর আর রবিনের হাত চেপে ধরল মুসা। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, গুড বাই, বন্ধুরা। অনেক কাল একসঙ্গে কাটিয়েছি আমরা। কত আনন্দ করেছি। সব। শেষ হয়ে যাচ্ছে এখন। গুড বাই!
দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে লাফ দেয়ার জন্যে প্রস্তুত হলো সে।
স্থির হয়ে গেল হঠাৎ।
ধীরে ধীরে এক পকেট থেকে বের করে আনল হাতটা।
একটা তাস।
মনে পড়ল, তাসটা বাক্স থেকে খসে মাটিতে পড়ে গেলে তুলে নিয়েছিল সে। মনের ভুলে পকেটে রেখে দিয়েছিল।
চিৎকার করে উঠল কিশোর। থামো থামো! একটা বুদ্ধি এসেছে আমার মাথায়!
.
২৪.
ফিরে তাকাল মুসা। অবাক। মানে!
হাত বাড়াল কিলোর। দেখি, তাসটা দাও আমার হাতে।
কি করবে?
তর্ক কোরো না! আহ, জলদি করো! মুসা দেয়ার আগেই সেটা ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল কিশোর।
মুক্তি নেই..মুক্তি নেই..মুক্তি নেই…
ঘোড়ার পিঠে বসা ক্রেলেরা গান গাইছে।
মাটিতে দাঁড়ানো ক্রেলেরা চলে এল বন্দিদের কয়েক ইঞ্চির মধ্যে। শীতল, নিষ্ঠুর দৃষ্টি। তরোয়াল তুলে খোঁচা মারার ভঙ্গি করল।
তৗসটা নিয়ে নিল কিশোর। পিঠে আঁকা জাদুকরের ছবিটা দেখল।
কাকু-কাকুর ছবি।
কি করবে ওটা দিয়ে? রবিনের প্রশ্ন। ওটা কি ভাবে বাঁচাবে আমাদের?
দাও ছুঁড়ে ফেলে! জাদুকরের ওপর প্রচণ্ড আক্রোশে ফুঁসে উঠল মুসা। কাকু কাকুকে সামনে পেলে এখন ওকেই ছুঁড়ে ফেলত পাহাড় থেকে।
উঁহু, মাথা নাড়ল কিশোর। ছুঁড়ে ফেললে লাভ হবে না। ছিঁড়ে ফেলতে হবে। জাদুর মায়া কাটবে হয়তো তাতে।
তাসটা সোজা করে ধরল কিশোর। ছিঁড়তে যাবে, আচমকা দমকা বাতাসে তাসটা টান দিয়ে কেড়ে নিল ওর হাত থেকে। ছুঁড়ে ফেলল চূড়ার কিনার দিয়ে।
নিজের অজান্তেই প্রচণ্ড চিৎকার বেরিয়ে এল কিশোরের কণ্ঠ চিরে।
ওদের আশা-…একমাত্র আশা…বাতাসে ভাসতে ভাসতে পড়ে যাচ্ছে নিচে। চূড়ার কিনার দিয়ে।
কোন রকম ভাবনা চিন্তা না করে ঝাঁপ দিল কিশোর।
থাবা মারল তাসটাকে ধরার জন্যে।
মিস করল।
মাথা নিচু করে পড়তে শুরু করেছে সে।
ওপরে মুসা আর রবিনের হাহাকার শোনা গেল। ক্রেলেরাও চেঁচাচ্ছে। আনন্দে। উত্তেজনায়।
উড়ে চলেছে যেন কিশোর।
মরিয়া হয়ে থাবা মারল আবার।
ধরে ফেলল তাসটা।
ফড়াৎ করে এক টান মেরে ছিঁড়ে ফেলল।
মাথা নিচু করে তীব্র গতিতে উপত্যকার দিকে উড়ে চলেছে তখন সে।
প্রচণ্ড আক্রোশে তাসটাকে টুকরো টুকরো করতে লাগল।
নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল, ভয়ঙ্কর গতিতে মাটি ছুটে আসছে তার দিকে।
তারপর হঠাৎ করেই সব অন্ধকার।
এত অন্ধকার…
গম্ভীর নীরবতা…
সেই সাথে ঠাণ্ডা।
কাজ কি হলো! ভাবল সে।
তাস ছিঁড়ে ফেলাতে কি কাটল জাদুর মোহ?
বাড়ি ফিরতে পারল?
নাকি সত্যি সত্যি মৃত্যু ঘটেছে এবার?
.
২৫.
ধীরে ধীরে কেটে গেল অন্ধকার।
গাড়ির শব্দ কানে এল।
স্পষ্ট হয়ে উঠল দিনের আলো।
বার কয়েক চোখ মিটমিট করে ফিরে তাকাল সে।
তার দুই পাশে একই রকম ভাবে বিমূঢ় ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখল মুসা আর রবিনকে।
আস্তে আস্তে কেটে গেল ঘোর।
দেখল, কাকু-কাকুর বাড়ির সামনের লনে পড়ে আছে ওরা।
বোঝার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। দৌড় দিল গেটের দিকে।
আরে কোথায় যাচ্ছ? শোনো! শোনো! পেছন থেকে ডাক দিল কিশোর।
ফিরেও তাকাল না মুসা। ছুটতে ছুটতেই জবাব দিল, আর একটা সেকেন্ডও আমি এখানে থাকব না। বাপরে বাপ! এবার নিশ্চয় ডাইনোসরের রাজত্বে পাঠাবে!
কথাটা সাবধান করে দিল কিশোর আর রবিনকেও। ওরাও উঠে দৌড় দিল। মুসার পেছন পেছন। জাদুকরের সীমানা থেকে পালিয়ে যেতে চায়।
গেটের কাছে গিয়ে কি ভেবে ফিরে তাকাল কিশোর।
কাকু-কাকুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সামনের দরজায়।
মিটিমিটি হাসছে।
প্রচণ্ড রাগ হলো কিশোরের। দাঁড়িয়ে গেল যেন হোঁচট খেয়ে।
তার গায়ে ধাক্কা খেল রবিন। কি হলো?
ওই লোকটার সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া আছে আমার! শীতল কণ্ঠে বলল কিশোর।
পাগল হয়েছ!
জবাব না দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। কাকু-কাকুর সঙ্গে কথা বলতে যাবেই।
খপ করে তার হাত চেপে ধরল রবিন। হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, পরে। এখন বাড়ি চলো। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে শান্ত হই। তারপর আমিও আসব তোমার সঙ্গে। আসলেই। এত সহজে ছেড়ে দেয়া যায় না ওকে।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে গেছে মুসাও। রবিন ঠিকই বলেছে। চলো, আগে বাড়ি চলো। আরও একজনেরও হিসেব নিতে হবে আমাদের। লীলা রেডরোজ। ওকেও ছাড়ব না আমি। খুঁজে বের করবই। ওর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করাটা বাকি রয়ে গেছে।
ঢিল হয়ে এল কিশোরের দেহ। মাথা ঝাঁকাল। বেশ। চলো। আগে বাড়িতেই যাই।