গাছগুলো অনেক উঁচু। মাথা ঢেকে দিচ্ছে। তবে খচমচ, খসখস নানা রকম শব্দ করেই চলেছে। এগোনোর সময় ঠেলা লেগে বাঁকা হয়ে গিয়ে আগা নুইয়ে ফেলছে।
মিনিটখানেক পর থেমে গেল কিশোর। এত জোরে হাঁপাচ্ছে, দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে। দম নেয়ার জন্যে।
চারপাশে লম্বা গাছগুলো বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে। পাতা খসখস করছে।
এখানে আমরা নিরাপদ, মৃদু স্বরে বলল রবিন। অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে হলেও। কি বলো, কিশোর?
হ্যাঁ, ফোঁস ফোঁস করে হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিল কিশোর। কেউ আমাদের দেখতে পাবে না।
কিন্তু এত লম্বা ভুট্টা গাছ আমি আর দেখিনি, মুসা বলল। এত মোটা আর…
কথা শেষ না করেই থেমে গেল সৈ। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ওর সামনের একটা গাছের বাকল খুলে যেতে শুরু করেছে।
দ্রুত নড়াচড়া চোখে পড়ল তার।
একটা হাত!
বাকলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা লিকলিকে হাত। কার্টুন ছবির মত।
আশপাশের অন্য গাছগুলোও খড়মড় কাঁচক্যাঁচ করে বিচিত্র শব্দ করছে। জ্যান্ত প্রাণীর মত দুলতে শুরু করেছে।
তারপর সেগুলোরও বাকল খুলে যেতে লাগল। লম্বা কাঠির মত চকচকে মসৃণ দেহগুলো বেরোতে থাকল গাছের ভেতর থেকে।
ডজন ডজন সরু সরু নীরব প্রাণী। সবুজ মসৃণ মাথা। কোন চেহারা নেই। মুখ নেই। পাতায় মোড়া সবুজ সবুজ মাথা। ভুট্টার মোচার মত।
ডজন ডজন!
ক্যাচক্যাচ শব্দ করে করে খুলতেই আছে গাছের দল। বেদম দুলছে আর ঝাঁকি খাচ্ছে ভেতরের কাঠি-প্রাণীগুলো বেরিয়ে আসার সময়।
মসৃণ হাতগুলো বাড়িয়ে দিচ্ছে। রবারের মত লম্বা হচ্ছে। ওদেরকে পেঁচিয়ে ধরতে শুরু করল সে-সব হাত। শক্ত হতে লাগল চাপ…
শক্ত…
স্টেলক! আচমকা চিৎকার করে উঠল রবিন। তাসের গায়ে আঁকা দেখেছিল এগুলোর ছবি। তাসের পিঠে নাম লেখা ছিল।
আমি…আমি মনে করতে পারছি না, মুসা বলল। কথা বেরোতে চাইছে না ঠিকমত। গলা চিপে ধরা হয়েছে যেন তার।
কিশোরেরও বুক পেঁচিয়ে ধরছে হাতগুলো। জীবন্ত আঙুর লতার মত। গলা পেঁচাচ্ছে। শক্ত হচ্ছে চাপ।
দম নিতে পারছি না আমি… হাঁসফাঁস শুরু করল কিশোর। দম নিতে পারছি না…।
শরীর মুচড়ে মুচড়ে ছাড়ানোর চেষ্টা শুরু করল মুসা। লাথি মারতে লাগল।
কিন্তু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখল ওদেরকে অদ্ভুত প্রাণীগুলো।
অনেক বেশি। সংখ্যায় অনেক বেশি ওগুলো।
আরও, আরও গাছ খুলতেই আছে। শয়ে শয়ে! হাজারে হাজারে! বেরিয়ে আসছে একের পর এক লতানো কাঠি-প্রাণী, স্টেলক।
কি করব আমরা এখন? কোনমতে বলল রবিন। শ্বাস নিতে পারছে না। গলার মধ্যে ঘড়ঘড় আওয়াজ হচ্ছে। কি করব…!
ঝাড়া মারো! ঝাড়া মারো! চিৎকার করে বলল মুসা। ঝাড়া, খামচি, লাথি, চড়-থাপ্পড় যখন যেটা পারছে মেরে চলেছে সে। স্টেরা মাংসাশী, বুঝে গেছে সেটা। বেরোতে না পারলে শ্বাসরোধ করে মারবে ওদের।
বহু কষ্টে স্টেলকদের কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করে ভুট্টা খেতের কিনারে বেরিয়ে এল ওরা। পাথরের মত স্থির হয়ে গেল মুহূর্তে।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা সেনাবাহিনী। ক্রেল। শত শত। ঘোড়ার পিঠে আসীন। কারও হাতে বল্লম। কারও তরোয়াল।
.
২৩.
সবার আগে নড়ে উঠল কিশোর। ঘুরে আবার দৌড় দিতে গেল ভুট্টা খেতের দিকে। কিন্তু দেরি করে ফেলেছে।
চোখের পলকে ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল ডজনখানেক ক্রেল। সামনে এসে পথরোধ করে দাঁড়াল। তরোয়াল ধরল বুকের ওপর।
নাহ, আর পারা গেল না! হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল মুসা। কোন জাদুকরের বাপও এসে এখন আর বাঁচাতে পারবে না আমাদের!
একটা মাঠের ওপর দিয়ে ওদেরকে হটিয়ে নিয়ে চলল ক্রেলেরা। ডজনখানেক সৈন্য ঘিরে রেখে এগোচ্ছে। কারও হাতে তরোয়াল, কারও হাতে বল্লম। বাকি সৈন্যরা ঘোড়ার পিঠে চেপে পেছন পেছন আসছে।
ধূসর মেঘের চাদরের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ। আরও ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে রাতের বাতাস। আরও ভেজা। কাদামাটিতে পিছলে যাচ্ছে বন্দিদের জুতো।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে হেঁটেই চলল ওরা। পা আর চলছে না। গলার ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ। কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে নেমে ঢুকে যাচ্ছে চোখের ভেতর।
হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল রবিন, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা আমাদের? এবার কি করবে? কেটেকুটে শিক কাবাব বানাবে?
জানি না, জবাব দিতেও আর ইচ্ছে করছে না কিশোরের।
অনন্তকাল ধরে যেন কেবল হাঁটতেই থাকব আমরা! মুসা বলল।
শেষ হলো মাঠ। বনে ঢুকল ওরা। লতানো উদ্ভিদে ভরা ঘন জঙ্গল। কাঁটা। ঝোঁপেরও অভাব নেই। সরু, আঁকাবাকা একটা রাস্তা চলে গেছে কাঁটা ঝোঁপগুলোর মাঝখান দিয়ে। হাঁটতে গেলে খোঁচা লাগে। ওদেরকে সেই পথ ধরে হটতে বাধ্য করল ক্রেলেরা।
বন থেকে বেরোল এক সময়। সরু সেই পথ ধরে কাদায় ভরা একটা ঢালু জায়গা দিয়ে ওদের নিয়ে চলল ক্রেলেরা।
পেছন পেছন আসতে আসতে সুর করে গেয়ে উঠল, মুক্তি নেই…মুক্তি নেই…মুক্তি নেই…
ঢোক গিলল কিশোর। পানির অভাবে খসখসে হয়ে যাওয়া কণ্ঠনালী ব্যথা করে উঠল। এক মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। পিঠে এসে লাগল বল্লমের খোঁচা।
সমস্ত যন্ত্রণা সহ্য করেও আবার পা ফেলতে বাধ্য হলো সে।
মুক্তি নেই মুক্তি নেই..মুক্তি নেই… কুৎসিত সুরে জঘন্য গানটা গেয়েই চলল ক্রেলেরা। শুধু এই দুটো শব্দই।
উপত্যকা পেরিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে আবার ওপরে উঠতে শুরু করল ঢাল।