কিন্তু ভুল করেছে কিশোর। জন্তুটাকে এতটা বোকা ভাবা ঠিক হয়নি। জাল থেকে ওদের বের করল না সে। জাল সহই ওদের নিয়ে চলল চুলার কাছে। প্রচণ্ড আগুনের হলকা এসে লাগল চোখে মুখে। পুড়ে যাবে মনে হলো চামড়া। আগুনের তপ্ত উজ্জ্বলতা সইতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলল কিশোর।
টের পেল ধীরে ধীরে মাথার ওপর থেকে সরে যাচ্ছে জাল। চোখ মেলল সে। প্রায় বেরিয়ে পড়েছে রবিন আর মুসা। আরেকটু সরল জাল। কিশোরও বেরিয়ে পড়ল। খপ করে ওকে আর মুসাকে চেপে ধরল রাক্ষসটা। ভাবল বোধহয়, সবচেয়ে বড় শরীরের দুটোকেই আটকে রাখবে। অন্যটা পালালে পালাক।
ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করতে লাগল মুসা। কিন্তু সাংঘাতিক শক্তিশালী রাক্ষসের হাত থেকে মুক্ত করতে পারল না নিজেকে।
না না, প্লীজ! চেঁচানো শুরু করল মুসা। দোহাই তোমার, শুয়োর-রাক্ষস, আমাদের ছেড়ে দাও। আমাদের মাংস ভাল না। মোটেও পছন্দ হবে না তোমার।
হ্যাঁচকা টান মেরে চুলার আরও কাছে ওদেরকে নিয়ে গেল রাক্ষসটা।
থামো! থামো! চেঁচিয়েই চলেছে মুসা।
জবাবে ঘোঁৎ-ঘোৎ করতে লাগল রাক্ষসটা। শুয়োরের চেহারার মুখটায় কোন রকম আবেগ লক্ষ করা গেল না।
চুলার মুখ দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেরোচ্ছে আগুনের শিখা। চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে আঁচ। তবে রাক্ষসটার কিছু হচ্ছে বলে মনে হলো না।
অবলীলায় দুই হাতে দুজনকে ধরে উঁচু করে ফেলল রাক্ষসটা। নিয়ে চলল চুলার মুখের কাছে।
প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে নাচানাচি ও চিৎকারের পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে কুকুরে প্রাণীটা। একবার আগে যাচ্ছে, একবার পেছনে, আবার আগে।
পেছন থেকে হঠাৎ কুঁই কুঁই করে উঠল ওটা। স্বর বদলে গেছে। ভীত কণ্ঠস্বর।
রাক্ষসের হাতে ঝুলতে ঝুলতেই ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকাল কিশোর। দেখল, ঘাড় ধরে কুকুরটাকে উঁচু করে ফেলেছে রবিন। সোজা নিয়ে গেলে চুলার মুখের কাছে। আগুনে ফেলে দেয়ার ভঙ্গি করল।
থমকে গেল রাক্ষসটা। গোটা দুই খাটোমত ঘোঁৎ-ঘোতানি বেরোল মুখ দিয়ে।
প্রথমে কিশোরকে মাটিতে নামাল রাক্ষসটা। তারপর মুসাকেও নামাল। কিন্তু হাত ছাড়ল না।
উত্তেজনা চলে গেছে কুকুরটার। আতঙ্কে কো-কোঁ করছে। বুঝে গেছে রবিনের উদ্দেশ্য।
ছাড়ো ওদের, রাক্ষস কোথাকার! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। নইলে দিলাম এটাকে আগুনে ফেলে!
দাঁড়িয়েই রইল রাক্ষসটা। ইতস্তত করছে।
ওর দুর্বলতাটা বুঝে গিয়ে আরও জোরে চিৎকার করে উঠল রবিন, ছাড়লে না এখনও! কুকুরটাকে চুলার একেবারে মুখের কাছে নিয়ে গেল সে। তার নিজের দেহেও যে ভয়াবহ আঁচ লাগছে, কেয়ারই করল না সেটাকে।
আতঙ্কে ত্রাহি চিৎকার শুরু করেছে কুকুরটা। খানিক আগে মুসা যে ভাবে শরীর মুচড়ে রাক্ষসের হাত থেকে ছুটতে চাইছিল, কুকুরটা করছে এখন সেরকম।
ভাল চাও তো ছাড়ো! চিৎকার করে উঠল রবিন।
রাক্ষসটা ওর ভাষা বুঝল কিনা বোঝা গেল না। তবে উদ্দেশ্য বুঝতে পারল। অবশেষে ছেড়ে দিল কিশোর আর মুসাকে। ওর কালো চোখে ভয় মেশানো আক্রোশ।
সরো এখন! বলার সঙ্গে হাত দিয়েও ইশারা করল রবিন। কুকুরটাকে ধরে রেখেছে চুলার মুখের কাছে।
বোঝা গেল, খাবারের চেয়ে কুকুরটার প্রাণ রাক্ষসটার কাছে বেশি প্রিয়। পিছিয়ে যেতে শুরু করল সে।
কিশোর, দৌড় মারো! রবিন বলল। কুকুরটাকে আগুনে ফেলে দেয়ার ভয়ে আমাদের কিছু করবে না সে।
দ্বিধা করছে কিশোর।
দেরি করছ কেন? যাও। কুকুরটাকে ছাড়ব না আমি, যতক্ষণ না নিরাপদ হতে পারছি।…দৌড়াও।
আর দেরি করল না কিশোর। মুসাকে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। হতাশ ভঙ্গিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে রাক্ষসটা।
কুকুরটাকে শক্ত হাতে বুকের সঙ্গে চপে ধরল রবিন। রাক্ষসটাকে হুমকি দিল, নড়বে না, খবরদার! নড়লেই আগুনে ফেশ্ব! যা বলল, সেটা ইশারাতে বুঝিয়ে দিল সে।
নড়ল না রাক্ষসটা। জোরে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। পরাজিত ভঙ্গিতে ঝুলে পড়ল তাঁর কাঁধ।
পিছাতে শুরু করল রবিন। সরে যেতে লাগল চুলার কাছ থেকে।
এগিয়ে আসার জন্যে পা বাড়াতে গেল রাক্ষসটা।
সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটার গলায় হাত রেখে গলা টিপে মারার ভয় দেখাল রবিন। থেমে গেল রাক্ষসটা।
কুকুরটাকে নিয়েই দৌড় মারল রবিন। বনের কিনারে এসে ফিরে তাকিয়ে দেখল, অসহায় ভঙ্গিতে আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে রাক্ষসটা। পোষা। প্রাণীটাকে সাংঘাতিক ভালবাসে সে। ক্ষতির আশংকায় সামান্যতম নড়াচড়া করছে না।
বনের কিনারে এনে কুকুরটাকে মাটিতে নামিয়ে রাখল রবিন। তারপর এক ছুটে ঢুকে গেল বনের মধ্যে। কিশোর আর মুসাকে দেখতে পেল। তার জন্যেই অপেক্ষা করছে।
রবিনকে দেখার পর একটা সেকেন্ডও আর দেরি করল না ওরা। ছুটতে শুরু করল বনের মধ্যে দিয়ে।
পেছন ফিরে তাকাল না আর কেউ। রাক্ষসটা আসছে কিনা, সেটাও দেখতে চাইল না। এত জোরে জীবনে দৌড়ায়নি ওরা।
ছুটতে ছুটতে দম আটকে আসতে চাইল ওদের। পা ব্যথা করছে। দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসছে। কিন্তু তার পরেও থামল না। ছোটা…ছোটা..ছোটা…
বনের বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। সামনে পাহাড়ের ঢাল। ঢালে জন্মে আছে ভুট্টা গাছের মত এক ধরনের গাছ। চাঁদের আলোয় বেড়ার মত লাগছে সামনের সারির গাছগুলোকে।
ওর মধ্যে লুকাতে পারব আমরা! আশা হলো রবিনের।
মাথা নিচু করে প্রায় ডাইভ দিয়ে গাছগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়ল ওরা। শুকনো খড়খড়ে গাছ। কখনও দুহাতে ফাঁক করে, কখনও কাধ দিয়ে ঠেলা মেরে সরিয়ে সরিয়ে এগিয়ে চলল। শুকনো পাতা জুতোর চাপে মচমচ করছে।