আসছে কে যেন! ফিসফিস করে বলল কিশোর।
শত্রু না হলেই হয়, জবাব দিল মুসা।
অদ্ভুত একটা জন্তু এসে দাঁড়াল জালটার কাছে। পুরো চেহারাটা নজরে এল। আত্মা শুকিয়ে গেল তিন গোয়েন্দার।
পরনে রোমশ চামড়ার পোশাক। মানুষের মতই দুই পায়ে হাঁটে। কালো চুলের দুই পাশে শুয়োরের কানের মত দুটো কান। ডগাটা ছুঁচাল। ওপর দিকে তোলা। মানুষের চোখ। শুয়োরের নাক। প্রায়-ঠোঁটহীন-মুখের দুই কোণ থেকে বেরিয়ে আছে ওয়ালরাসের মত লম্বা দাঁত।
হাল্লো! খাতির করার চেষ্টা করল মুসা। জাল থেকে আমাদের ছুটাতে এসেছেন?
জালের দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে জীবটা। লম্বা তিন আঙুলের ডগায়। বসানো জানোয়ারের মত বাকা নখ। লম্বা চুলের মধ্যে সেগুলো ঢুকিয়ে দিয়ে মাথা চুলকাল।
হাল্লো! ইংরেজি জানেন আপনি? জিজ্ঞেস করল আবার মুসা।
জবাবে ঘোঁৎ-ঘোৎ করে উঠল জীবটা। শুয়োরের মতই। বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে এল চাপা সে-শব্দ।
প্লীজ… বলতে গেল আবার মুসা।
কিন্তু তীক্ষ্ণ একটা লম্বিত হেউপ হেউপ হেউপ ডাকে থেমে গেল সে।
বনের ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল চার পাওয়ালা ছোট একটা জানোয়ার। বড় জীবটার পাশে এসে দাঁড়াল। বন্দিদের দেখে উত্তেজিত হয়ে ডাকাডাকি করতে লাগল। জালের চারপাশ ঘিরে নেচে বেড়াতে লাগল। কালো কালো ছোট খুর দিয়ে খোঁচা মারছে জালের দড়িতে। পারলে ওপরে উঠে এসে বন্দিদের। গায়েই খোঁচা মারে।
জানোয়ারটা দেখতে অনেকটা ছোট জাতের কুকুরের মত। গায়ের চামড়া লোমহীন। মানুষের চামড়ার মত। তবে অনেক বেশি মসৃণ আর চকচকে। হলুদ রঙের। কুকুরের মতই হেক হেক করে ডাকছে। হাই তোলার ভঙ্গিতে হাঁ করে এক সময় দুই সারি চিকন ধারাল দাঁত দেখিয়ে দিল।
বড় জম্ভটা ঘোৎ-ঘোৎ করে ছোটটার মাথা চাপড়ে দিল। বোধহয় শান্ত হতে বলল। ছোট কুকুরের মত জন্তুটা চিৎকার থামিয়ে দিয়ে আদর পাওয়া বিড়ালের মত গরগর করতে লাগল।
জাল ধরে টানতে শুরু করল শুয়োর-মানব।
আমাদের ছেড়ে দিচ্ছে! খুশিতে চিৎকার করে উঠল মুসা।
কিন্তু ভুল করেছে সে।
বন্দিদের ছাড়ল না শুয়োর-মানব। বরং জালের মধ্যেই আটকে রেখে জাল। সহ ওদের টেনে নিয়ে চলল বনের মধ্যে দিয়ে।
কোনমতেই বেরোতে পারল না গোয়েন্দারা। সাংঘাতিক শক্তি জটার গায়ে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে অবলীলায় টেনে নিয়ে চলল তিন তিনজন মানুষ সহ এ রকম একটা ভারী জাল। অসহায় হয়ে জালের মধ্যে চিত হয়ে রইল তিন গোয়েন্দা।
শিকার ধরা পড়লে কুকুর যা করে, ঠিক সে-রকমই করতে লাগল ছোট আকারের কুকুরে-শুয়োর কিংবা শুয়োরে-কুকুরটা। চিৎকার-চেঁচামেচি, হাঁক-ডাক লাফালাফি সবই করছে। একবার ছুটে সামনে চলে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে। জাল ঘিরে চক্কর দিতে দিতে নাচানাচি করছে।
চলার সময় ক্রমাগত ঘোৎ-ঘোৎ করছে শুয়োর-মানব। তার ওয়ালরাস দাঁতের গা বেয়ে জানোনায়ারের মত লালা গড়াচ্ছে। লম্বা নীল জিভ বের করে জানোয়ারের মতই চেটে নিচ্ছে সেগুলো।
জালের মধ্যে বড়ই কষ্ট হচ্ছে গোয়েন্দাদের। চিত হয়ে থেকেও আরাম পাচ্ছে না। টানার সময় প্রচণ্ড ঝাঁকি লাগছে। গায়ে গায়ে বাড়ি খাচ্ছে। ব্যথা লাগছে রীতিমত।
অবশেষে থামল জন্তুটা। জাল টানা বন্ধ হলো।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। হাঁটু ডলছে মুসা। নীরবে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে রবিন।
জম্ভটা কোথায় নিয়ে এল ওদের?
লম্বা, নিচু, ধূসর রঙের একটা পাথরের বাড়ি দেখা গেল। এক মাথায় একটা দরজা। জানালা-টানালা নেই।
শুয়োর-মানবের বাড়ি?
জোরাল ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে, লম্বা দাঁত চাটতে চাটতে, বড় বাড়িটার পাশের ছোট একটা ঘরের দিকে এগিয়ে গেল জটা। সামনের একটা পাথরের দরজা খুলল।
সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে বেরিয়ে এল আগুনের শিখা।
একটা বেলচা তুলে নিল জটা। আগুনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। খোঁচানো শুরু করল। তারপর আরও কিছু কয়লা ফেলল আগুনে।
কিশোর, ওটা কি? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রবিন।
ঢোক গিলল কিশোর। চুলাই তো মনে হচ্ছে।
খাইছে! চমকে গেল মুসা। ওর মধ্যে ফেলে কাবাব বানাবে আমাদের? এ তো রাক্ষস মনে হচ্ছে! রূপকথার রাক্ষস!
জবাব দিল না কিশোর। তাকিয়ে আছে জন্তুটার দিকে। ক্ষুধার্ত ভঙ্গিতে দাঁত চাটছে। চুলার কয়লা খুঁচিয়েই চলেছে। পাগল হয়ে যেন লাফালাফি করছে আগুনের শিখা।
কি করব আমরা, কিশোর? প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে রবিন। কোন একটা বুদ্ধি বের করো। জলদি! পারবে বের করতে?
আবার ঢোক গিলল কিশোর।
নাহ, শুকনো স্বরে জবাব দিল সে। কোন বুদ্ধিই আসছে না মাথায়।
.
২২.
চুলায় আরও দুতিন বেলচা কয়লা ফেলল রাক্ষসটা। লাল টকটকে কয়লার তাপ বাইরে বেরিয়ে আসতে লাগল। তারপর সন্তুষ্ট হয়ে বেলচাটা ছুঁড়ে ফেলল একদিকে। গোয়েন্দাদের দিকে ফিরে থপথপ করে এগিয়ে আসতে শুরু করল।
ওর শুয়োরের মত মুখে ক্ষুধার্ত হাসি ছড়িয়ে পড়েছে। হলুদ রঙের কুকুরের মত প্রাণীটাও উত্তেজিত ভঙ্গির্কে হাঁপাচ্ছে। রাক্ষসটাকে ঘিরে চক্কর দিতে দিতে এগোতে লাগল জালের দিকে।
চাঁদি দপদপ করছে কিশোরের। বুকের মধ্যে ধুড়স ধুড়স করছে হৃৎপিণ্ডটা। হাজার রকম ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে মগজে। মরিয়া হয়ে বাঁচার উপায় খুঁজছে।
জালটা এখন তুলবে, ফিসফিস করে বলল কিশোর। ভোলার সঙ্গে সঙ্গে দৌড় মারবে। একসঙ্গে তিনজনকে ধরতে পারবে না রাক্ষসটা।