নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। আমরা রয়েছি তাসের জগতে। তাসের খেলায়। আমাদের চরিত্র বানিয়ে খেলছে জাদুকর।
কাকু-কাকু তারমানে সত্যিই জাদুকর, মুসা বলল।
তাতে আর কোন সন্দেহ আছে এখন?
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মুসা বলল, কিন্তু আমরা এখন কি করব? আমাদের বাড়ি ফিরে যাবার উপায় কি? আলীবাবার পাহাড়ের গুহা খোলার মত কোন জাদুই শব্দ ব্যবহার করব নাকি? সিসেম ফাঁক! সিসেম ফাঁক!
সিসেম ফাঁক! মুসার দিকে তাকাল কিলোর। চিন্তিত মনে হচ্ছে ওকে। উঁহু। ওরকম মন্ত্রে কাজ হবে না…
তাহলে কিসে হবে? অস্থির হয়ে উঠেছে মুসা। কিশোর, কিছু একটা করো। ইস, কোন কুক্ষণে যে সেদিন কাকু-কাকুর বাড়িতে জিনিস বিক্রি করা দেখতে গিয়েছিলাম…
ফিরে যেতে হলে আবার তাসগুলো প্রয়োজন হবে আমাদের, মুসার কথায় কান নেই কিশোরের। ওগুলো সব একসাথে করে বাক্সে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই আবার তাসের জগৎ থেকে বেরিয়ে যাব আমরা।
কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে তাসগুলো? মুসার প্রশ্ন।
চাঁদের আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে ঘাসের মাঠটা। বাতাস বাড়ছে। ঠাণ্ডা। ভেজা ভেজা।
জাদুকরের বাড়ির মেঝেতে নিশ্চয় পড়ে আছে এখন, শুকনো কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর।
দমে গেল মুসা। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাহলে আর পাব কি করে?
চলো, হাটা শুরু করি, রবিন বলল। কোন না কোন শহর পেয়েই যাব। কোথাও না কোথাও একটা ফোনও পাওয়া যাবে।
রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। ব্যাপারটা দেখছি এখনও পুরোপুরি বোধের মধ্যেই যায়নি তোমাদের। ফোন নেই এখানে। শহরও পাবে না। মধ্যযুগীয় কোন একটা সময়ে প্রবেশ করেছি আমরা। কিংবা রূপকথার জগতে। যেখানে ড্রাগন, নাইট আর এলফের মত প্রাণীদের রাজত্ব।
চাঁদের আলোয় মুসা আর রবিন দুজনের চোখেই অস্বস্তি দেখতে পেল সে।
তবে, কিশোর বলল, এ থেকে বেরোতে আমাদের হবেই। কোন না কোন উপায় একটা বের করতে হবে। তাসের এই গেমের মধ্যে থেকে গেলে মৃত্যু অবধারিত।
কিন্তু সেই উপায়টা কি? মুসা বলল, এখানে এ ভাবে বসে বসে ভাবতে থাকলেই কি চলবে? বাড়ি আর কোনদিন পৌঁছানো হবে না তাহলে।
তা বটে, উঠে দাঁড়াল কিলোর। ঠাণ্ডা বাতাসে গায়ে কাঁটা দিল তার। মাটিতে কাঁপুনি তুলে থপ্ থপ্ করে হেঁটে যাওয়া ড্রাগনটার কথা ভাবল সে। কেঁপে উঠল আরেকবার।
একটাকে যখন দেখলাম, নিশ্চয় বুনো ড্রাগন আরও আছে। রাতের বেলা এ পথে চলাফেরা করে ওরা।
কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না, বুনো এই দৈত্যগুলোকে পোষ মানাল কি করে নাইটেরা? রবিনের প্রশ্ন।
হাতিকে ধরে আমরাও তো পোষ মানাই, জবাব দিল কিশোর। নিশ্চয় আছে কোন কায়দা।
নিচের উপত্যকার বনটার দিকে তাকাল সে। বনেই ঢুকে পড়ব না-কি? নিজেকেই প্রশ্ন করল যেন। হয়তো বনের মধ্যেটা এখানকার চেয়ে নিরাপদ। হয়তো রাস্তাটাস্তাও পেয়ে যেতে পারি। তাহলে লোকালয়ে পৌঁছানো সম্ভব হতে পারে। স্বাভাবিক মানুষদের গ্রামে।
মাথা ঝাঁকাল রবিন। কিছু বলল না। মুসা চুপ করে রইল।
হাঁটতে শুরু করল ওরা। আগে আগে চলেছে কিশোর।
ঢুকে পড়ল বনের মধ্যে। পায়ের নিচের মাটি এত নরম, জুতো দেবে যায়। পিছলে যায়। দ্রুত এগোনো তাই কঠিন।
থামল না ওরা। এগিয়ে চলল।
কয়েক মিনিট হাঁটার পর মাটিতে কিসের ওপর যেন পা পড়ল মুসার। নিচে তাকাল। গাছের ডালের মত কি যেন।
মট করে কিছু একটা ভাঙল।
গাছের ওপর থেকে নেমে এল ভারী একটা জাল। মাথার ওপর পড়ল তিনজনের।
ফাঁদ! ফাঁদ! চিৎকার করে উঠল কিশোর। ধরা পড়ে গেলাম আমরা।
.
২১.
এত ভারী জাল যে, ভারের চোটে বসে পড়তে হলো ওদের।
ধস্তাধস্তি করে গায়ের ওপর থেকে সরানোর চেষ্টা করল। দুই হাতে অনেক কষ্টে মাথার ওপর জালটা উঁচু করে ধরল মুসা। আবার উঠে দাঁড়াতে চাইল।
কিন্তু সাংঘাতিক মোটা দড়ি। খসখসে। ধারাল শন জাতীয় কোন কিছু দিয়ে তৈরি। হাতে কেটে বসে যায়। সুবিধে করতে পারল না সে।
তিনজনে মিলে নড়ানোর চেষ্টা করেও নড়াতে পারল না।
বাপরে বাপ! বলে উঠল মুসা। কি জিনিস দিয়ে তৈরি?
যেটা দিয়েই হোক, গুঙিয়ে উঠল রবিন। বেরোতে তো হবে আমাদের।
হ্যাঁ, চেষ্টা চালিয়ে যাও, কিশোর বলল। থেমো না।
কিন্তু বহু চেষ্টা করেও গায়ের ওপর থেকে জালটা ফেলতে পারল না ওরা। ভারী তো বটেই, তৈরিও করা হয়েছে এমন করে, যাতে নিচে পড়লে কোনমতেই ছুটতে না পারে শিকার। জালে আটকা পড়লে পাখির কেমন কষ্ট লাগে, হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারল ওরা এখন।
এরপর কি ঘটবে?
ভয়ঙ্কর সব ভাবনা খেলে যাচ্ছে কিশোরের মগজে। এতই ভয়ানক, সেগুলো মুসা আর রবিনকে বলে ওদের ভয় পাওয়াতে ইচ্ছে করল না ওর।
যদি এমন হয়, জালটা পাতা হয়েছে বহুকাল আগে? কেউ আর এখন দেখতে আসে না জালে শিকার পড়ল কিনা, কি ঘটবে তাহলে?
কেউ ওদের উদ্ধার করতে আসবে না। এই জালের নিচে আটকা পড়ে থেকে খেতে পেয়ে তিলে তিলে ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় মৃত্যু ঘটবে ওদের।
আর যদি নতুন পাতা হয়ে থাকে, কে পাতল? কি ধরার জন্যে পাতল? মানুষ?
জেকিলদের আচরণের কথা মনে করে গায়ে কাঁটা দিল ওর।
পায়ের শব্দ শোনা গেল। বনতলে বিছিয়ে থাকা পাতার পুরু আস্তরণের ওপর দিয়ে কে যেন হেঁটে আসছে। শুকনো পাতায় পা পড়ে মচমচ শব্দ হচ্ছে। বরফর মত জমে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল ওরা।