ভুলে জিভ দিয়ে চেটে ঠোঁট পরিষ্কার করতে গেল কিশোর। জিভে লাগল। বিষের স্বাদ।
পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল।
কিন্তু সব কিছু ভুলে গেল বিশাল ড্রাগনটাকে দেখে।
আবার গর্জন।
আরেকটা ড্রাগন দেখা গেল। শরীর দোলাতে দোলাতে দৌড়ে আসছে ঘাসে ঢাকা মাঠের ওপর দিয়ে। তারপর আরও একটা ড্রাগনকে দেখা গেল।
ড্রাগনে সওয়ার আরোহীদেরকেও চোখে পড়ল তার। ড্রাগনের লম্বা, ওপরের দিকে বাঁকানো ঘাড়ে বসে আছে সারা দেহ বর্মে আবৃত যোদ্ধারা। ড্রাগনের পিঠের কাঁটা ওদের বিশেষ অসুবিধে করছে বলে মনে হচ্ছে না।
ওরা নাইট। হাতের তরোয়াল আর ঢাল আগুনের আলোয় চকচক করছে।
ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করছে ড্রাগনগুলো। খুলছে আর বন্ধ করছে ধারাল দাঁতওয়ালা চোয়াল। মাড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিল খড়ের গাদা। নেতার কুঁড়ের দিকে দৌড়ে গেল একটা ড্রাগন। ম্যাচ বাক্সের মত ভর্তা করে ফেলল ওটাকে।
হেলমেট আর বর্ম পরা ড্রাগনের লম্বা ঘাড়ে ঝুলে থেকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। নিচের দিকে। তরোয়াল ঘুরিয়ে কোপ মারছে হতবাক জেকিলদের।
হট্টগোল আর আর্তনাদে ভরে গেল মাঠটা। উল্লসিত নাইটদের যুদ্ধ চিৎকার। ড্রাগনের তীক্ষ্ণ, কর্কশ ডাক। আতঙ্কিত জেকিলদের গোঙানি আর আর্তনাদ।
শয়তান খুদে মানবের দল তাদের বল্লম ফেলে দিল দৌড়। ওদের নেতা পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে দলের লোকদের ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগল। ফিরে এসে যুদ্ধ চালাতে বলল।
হাসতে হাসতে মুসার বুকে অসততা ধাক্কা দিয়ে কিশোর বলল, বাপরে! কি একখান লড়াই। তোমার খেলা গেমটার মত।
এতে হাসির কি আছে বুঝতে পারল না মুসা। বলল, চলো, সময় থাকতে পালাই!
উল্টো দিকে ঘুরে দৌড়ানো শুরু করল গোয়েন্দারা। সরে যেতে লাগল জেকিল, নাইট আর তাদের ড্রাগনদের কাছ থেকে। জেকিলদের অগ্নিকুণ্ড আর কুঁড়ের কাছ থেকে।
নরম মাটিতে ব্যাপ থ্যাপ পায়ের শব্দ হতে লাগল ওদের। প্রাণপণে ছুটছে। ঘাস বন পেরিয়ে চওড়া একটা মেটে ঢেলার খেত সেটার ওপর দিয়ে ছুটল। যুদ্ধ থেকে দূরে। শয়তান জেকিলদের কাছ থেকে দূরে।
জোরে জোরে হাঁপাতে হাঁপাতে বুকের মধ্যে ব্যথা শুরু হয়েছে কিশোরের। ফিরে তাকাল সে।
কুঁড়েগুলো এখন জ্বলছে। কমলা আগুনের লকলকে শিখা উঠে যাচ্ছে। আকাশপানে। রাতের বেগুনী আকৗশ। মনে হচ্ছে ঘাসে ঢাকা সমস্ত সমভূমিটাতেই আগুন ধরে গেছে। দাবানলের মত।
জেকিলেরা সব গায়েব। ড্রাগনের পিঠে চড়ে মাঠময় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। নাইটেরা। উল্লাসে মাথার ওপর তরোয়াল উঁচু করে ধরে নাচাচ্ছে আর চিৎকার করছে।
ছুটতে থাকো, কিশোর বলল তার দুই সঙ্গীকে। ছুটতে ছুটতেই শার্টের হাতা গুটিয়ে নিল। থেমো না। এই নাইটগুলোকেও বিশ্বাস নেই। ওরাও আমাদের শত্রু।
আমাদের দেখে ফেললেই এখন সর্বনাশ, রবিন বলল। তেড়ে আসবে। ড্রাগনের সঙ্গে দৌড়ে পারব না আমরা।
ধরা পড়লে কাম শেষ, মুসা বলল।
আবার ফিরে তাকাল কিশোর। জ্বলন্ত কুঁড়ের আগুনের আলোয় এখনও উল্লাস করতে দেখা যাচ্ছে ড্রাগনারোহী নাইটদের। বিজয়ের আনন্দে মেতে আছে।
লড়াইটা মোটেও ন্যায্য হলো না, মুসা বলল। আমি বলতে চাইছি, একটা অসম লড়াই হলো। বড় বড় টানে তাজা ঠাণ্ডা বাতাস যেন বুক ভরে গিলে নিল মুসা।
মরুক না ব্যাটারা, ক্ষোভ চাপা দিতে পারল না কিশোর। তাতে আমাদের কি? আমাদের তো বিষ খেতে বাধ্য করছিল ওরা।
মনে করতেই পচা দুর্গন্ধটা যেন নাকে এসে লাগল কিশোরের।
ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিল আবার।
কাছিমের পিঠের মত বাঁকা হয়ে নেমে গেছে এখানে সমভূমিটা।
নিচে জঙ্গল। ওখানে আবার কোন ভয়ঙ্কর প্রাণীরা লুকিয়ে আছে কে জানে! কিন্তু ড্রাগন আর নাইটদের হাত থেকে পালাতে হলে এখন ওদিকেই যেতে হবে। আর কোন পথ নেই।
নেমে চলল ওরা।
আচ্ছা, কোথায় রয়েছি আমরা, বলো তো? চলতে চলতে রবিন বলল। কোন জায়গায়? কি ভাবে ঘটল এ সব? আমাদের বাড়িঘরগুলোই বা কোথায়?
কিশোর বা মুসা কথা বলার আগেই ভারী পায়ের শব্দ হলো।
পায়ের চাপে মাটি কাঁপছে।
গুম! গুম! গুম! গুম!
রবিনের হাত ধরে টান মারল কিশোর। ডাগন আসছে! জলদি পালাও!
গুম! গুম! গুম! গুম!
চাঁদের আলোয় দেখা গেল ড্রাগনটাকে। ওপরে কাছিমের পিঠের মত বাকা। জায়গাটার কিনার ধরে চলেছে। হাটার তালে তালে দুলছে বিশাল বপু। ডানা। দুটো কাঁটা বসানো কাঁধের কাছে আধখোলা, উঁচু করে রেখেছে।
ছোট ঝোপের মধ্যে ঘাপটি মেরে রইল ওরা।
লম্বা, বৰ্ম বসানো গলাটা বাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে আছে ড্রাগনটা। চোয়াল বন্ধ। হাঁটার সময় ওপরে নিচে দুলছে মস্ত মাথাটা। ওটার ঘাড়ে কোন নাইটকে দেখা গেল না।
কিশোরের হাত ধরে চাপ দিল রবিন। মুসা তার গা ঘেঁষে রয়েছে। নীরবে ড্রাগনটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিনজনে। বুক কাঁপছে। সবার মনে একই প্রশ্ন।
ড্রাগনটা কি দেখে ফেলেছে ওদের?
গন্ধ পেয়েছে?
খুঁজছে ওদেরকে?
না। একই ভঙ্গিতে হেঁটে সরে যেতে লাগল ওটা। এক সময় চাঁদের আলো থেকে মুছে গেল। হারিয়ে গেল অন্ধকার দিগন্তে।
পুরো একটা মিনিট আরও চুপচাপ বসে রইল ওরা। বুকের কাপুনি কমার অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর নীরবতা ভাঙল কিশোর। ফিসফিস করে বলল, ওটা বুনো। নাইটদের হাতে পড়েনি এখনও। পোষ মানানো হয়নি।
কিন্তু আমরা আছি কোথায়? একটু আগে রবিনের করা প্রশ্নটাই মুসাও করল। দুঃস্বপ্নে?