ছোট ছোট বামন, কিশোরের দিকে কাত হয়ে ফিসফিস করে বলল মুসা। ওদের এত ভয় পাচ্ছি কেন আমরা? ছুটে পালালেই তো পারি।
মাথা নাড়ল কিশোর। উঁহু। খবরদার। সেই চেষ্টাও কোরো না। দেখতে ছোট হলে কি হবে। ওদের গায়ে অমানুষিক জোর। তা ছাড়া হাতে বল্লম। সাংঘাতিক নিশানা। মিস করে না।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। তাহলে কি করব আমরা?
জবাব দেয়ার সুযোগই পেল না কিশোর। ঘষার শব্দ কানে এল। কাশি শোনা গেল। সাদা চামড়ার পোশাক পরা একটা জেকিল ছুটে বেরিয়ে এল কুঁড়ের নিচু দরজা দিয়ে।
ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা। বোঝার চেষ্টা করছে, কি খবর নিয়ে আসছে লোকটা। গায়ের চামড়ার ফতুয়া আর পাজামা আগুনের আলোয় চকচক করছে। বাকি সবার মত কালো চুল নয় এর। ঝকড়া সোনালি চুলের বোঝা। চওড়া কপাল। জ্বলজ্বলে নীল চোখ।
মেহমান, অদ্ভুত রকম ভারী গলায় বলে উঠল আগন্তুক। মেহমান, আবার একই কণ্ঠে একই শব্দ উচ্চারণ করল লোকটা।
আপনি…আপনি ইংরেজি জানেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা ঝাঁকাল লোকটা। জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কিশোরের দিকে। তোমাকে দেখে তো নাইট বলে মনে হচ্ছে না, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল সে। ক্রেলের মতও লাগছে না।
তিন গোয়েন্দার দিকে এগিয়ে এল লোকটা। সরে নেতাকে জায়গা করে দিল দুজন জেকিল। তোমরা কি পথ? নাকি জাদুকর?
আগুনের আলো খেলা করছে তার দুচোখে। দুই হাত কোমরে রেখে তাকিয়ে আছে সে। জবাবের অপেক্ষা করছে।
আমরা…আমরা অতি সাধারণ মানুষ, জবাব দিল কিশোর।
চোখের পাতা সরু করে চোখ প্রায় আধবোজা করে তাকাল লোকটা। সাধারণ মানুষ! তোমরা কি শক্তিশালী?
না! চিৎকার করে উঠল রবিন। আমাদের কোন ক্ষমতাই নেই। আমাদের যেতে দিন। প্লীজ!
আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি, শান্তকণ্ঠে লোকটাকে বোঝানোর চেষ্টা করল কিশোর। আমরা সৈনিক নই। আমরা…আমরা ছাত্র। আমরা ছেলেমানুষ।
মসৃণ চোয়াল ডলল লোকটা। তাহলে ছেলেমানুষ-ছাত্র তোমরা এলে কেন এখানে?
এক দুষ্ট জাদুকর আমাদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছে এখানে, জবাব দিল কিশোর। আমরা ইচ্ছে করে আসিনি…
জাদুকর শুনেই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল জেকিলরা। বল্লম তুলে নাচাতে শুরু করল।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল ওদের নেতার। জাদুকরে পাঠিয়েছে? তারমানে তোমরাও জাদুকর।
না! চেঁচিয়ে বলল কিশোর। নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। আমাদের কোন ক্ষমতা নেই। কোন ক্ষমতাই নেই। যা ঘটেছে, পুরোটাই একটা ভুলের কারণে। ভুল বোঝাবুঝির কারণে।
এক এক করে তিন গোয়েন্দার মুখের দিকে তাকাতে থাকল লোকটা। বিড়বিড় করে বলল, তাই না? বেশ, দেখা যাক।
দলের লোকের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠে কি আদেশ দিল নেতা। সঙ্গে সঙ্গে দুজন জেকিল দৌড় দিল একটা কুঁড়ে ঘরের দিকে। ভেতরে ঢুকে গেল।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বেরিয়ে এল সে। একজনের হাতে একটা রূপার বড় পানপাত্র। দুই হাতে শক্ত করে ধরে আছে সেটা। যেন মহামূল্যবান বস্তু রয়েছে ভেতরে।
লোকটা কাছে এলে পাত্রটা তার হাত থেকে নিয়ে নিল নেতা। তিন গোয়েন্দার সামনে নিচু করল, যাতে ভেতরে কি আছে দেখতে পায় ওরা। রূপার পাত্রে কালচে রঙের কি যেন রয়েছে। পাক খাচ্ছে। বুদবুদ উঠছে। ফোঁটার সময় হয়েছে তরল পদার্থটার।
এঁহ! একবার তাকিয়েই মুখ চোখ বিকৃত করে ফেলল কিশোর। পচা মাংসের গন্ধ বেরোচ্ছে জিনিসটা থেকে।
নাও, এটা তোমাকে খেতে হবে, পাত্রটা কিশোরের দিকে বাড়িয়ে দিল নেতা।
উঁহু! খেতে পারব না! পেটের মধ্যে গোলানো শুরু হয়ে গেছে তার। দুই হাতে নাক টিপে ধরে রাখল।
তারপরেও কি করে যেন নাকে ঢুকে যাচ্ছে ভয়ানক দুর্গন্ধ। এত খারাপ গন্ধের কথা কল্পনাই করা যায় না। পচা মাংস, পচা মাছ আর খটাশের গন্ধ একসঙ্গে করলে যা হয়, তা-ই হয়েছে।
ঘন কালো তরল পদার্থ পাত্রের কিনার বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
খাও খাও, জলদি খাও, ধমকে উঠল জেকিল-নেতা। তাড়াহুড়া করে গিলতে পারলে আর অত খারাপ লাগবে না।
কিন্তু…জিনিসটা কি? নাক থেকে হাত না সরিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর। বিকৃত শোনাল কথাটা।
বিষ, অকপটে জবাব দিল লোকটা। মারাত্মক বিষ।
দম আটকে ফেলল কিশোর। কিন্তু কেন?
এটা আমাদের সত্য-পরীক্ষা, বুঝিয়ে দিল লোকটা। এটা খাওয়ার পরেও যদি তুমি বেঁচে থাকো, তাহলে বুঝতে হবে তুমি সত্যি কথা বলছ।
ফুটতে থাকা কালো তরলটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। কিন্তু, চিৎকার করে উঠল সে, কেউ কি এ জিনিস খেয়ে বাঁচতে পেরেছে?
মাথা নাড়ল লোকটা। না। এখনও কেউ পারেনি।
কতক্ষণ আর নাক ধরে থাকা যায়। হাত সরালেই দুর্গন্ধে পেটের মধ্যে গুলিয়ে উঠছে। বমি আসতে চাইছে। এত ভয়াবহ দুর্গন্ধ, শুধু গন্ধেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে সে।
খাও, আদেশ দিল আবার নেতা। সত্য-পরীক্ষা তোমাকে খেতেই হবে। নাও, ধরো। খাও।
এক হাতে ওর মাথা চেপে ধরল লোকটা। অন্য হাতে পাত্রটা চেপে ধরল। ঠোঁটের সঙ্গে।
.
২০.
গরম, আলকাতরার মত ঘন তরলের স্পর্শ পেল মুখের বাইরে কিশোর।
দুর্গন্ধে ভরা বাষ্প আটকে যাচ্ছে সারা মুখে।
কানফাটা একটা গর্জন কানের পর্দা কাঁপিয়ে দিল হঠাৎ।
পাত্রটা জেকিলের হাত থেকে পড়ে গেল। ঘন তরল পদার্থ ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
আবার গর্জন। মাটি কেঁপে উঠল।
পিছিয়ে গেল জেকিল-নেতা। বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেছে চোখ।