মুসার রসিকতায় হাসল না রবিন।
কাকু-কাকুর সামনের চত্বরের সুন্দর করে ছাঁটা লন মাড়িয়ে ছুটল দুজনে। খোলা গ্যারেজের সামনে চার-পাঁচজন প্রতিবেশী। জিনিসপত্র ঘটছে।
চাবুক, করাত বা ও রকম কোন কিছুই দেখল না। অতি সাধারণ জিনিসপত্র। প্রথম টেবিলটার সামনে এসে দাঁড়াল মুসা। শিকার ও মাছ ধরার ওপর পুরানো একগাদা ম্যাগাজিন। বেশ চকচকে একজোড়া পুরানো ফ্যাশনের জুতো। একটা টোল খাওয়া দূরবীন। ঝিনুকের মত দেখতে একটা অ্যাশট্রে।
দূর, ফালতু জিনিস সব!
দাম কত এটার? সোনালী ফ্রেমে বাঁধাই একটা তৈলচিত্র তুলে দেখাল এক জিপসি মহিলা। রক্তিম সূর্যাস্তের সময় পালতোলা নৌকার ছবি।
মহিলা কাকু-কাকুর প্রতিবেশী। নাম লীলা রেডরোজ। এ এলাকায় এসেছে খুব বেশি দিন হয়নি। এ-ও আরেক বিচিত্র চরিত্র। কারও সঙ্গে মেশে না। কথা বলে না। একা একা ঘরে বসে থাকে। তাই পড়শীরাও ওকে এড়িয়ে চলে। সেটাও আবার ওর ভাল লাগে না। ভাবে, তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে। ছোটদের ধারণা, বাড়ি বসে থেকে নানা রকম জড়িবুটির গবেষণা করে বুড়ি। তুকতাকের বিদ্যে শেখে! প্রেতসাধনা করে।
একশো ডলার, হাকল মিস্টার কাকু-কাকু। গ্যারেজের ভেতরে আরাম করে ফোল্ডিং চেয়ারে বসে আছে সে। হলদে রঙের পাতলা দুই হাতের তালুতে মাথার পেছনটা এলিয়ে দেয়া।
মাথায় ঝাঁকড়া চুল। সব সাদা। ঠিক মাঝখানে সিঁথি। সাদা মস্ত গোঁফজোড়া দেখতে অদ্ভুত। দুই পাশ থেকে বিচিত্র ভঙ্গিতে বেরিয়ে রয়েছে কোনা দুটো। মুখটা আপেলের মত টকটকে লাল। কেমন চারকোনা।
সবচেয়ে অদ্ভুত ওর চোখ দুটো। শয়তানি ভরা। নীল। সারাক্ষণই যেন রাগে জ্বলে। আনমনে বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গে কথা বলে লোকটা। ক্রমাগত ভ্রুকুটি করে।
পরনে ঢোলা খাকি রঙের পাজামা। তাতে প্রচুর দাগ। গায়ে লাল টি-শার্ট। খাটো। ফুলে ওঠা ভুড়িটা পুরোপুরি ঢাকতে পারেনি।
টেবিলে কাত করে ছবিটা নামিয়ে রাখল রেডরোজ।
ভাল করে রাখুন। ভাঙলে কিন্তু আপনাকেই নিতে হবে, কাকু-কাকু বলল। খসখসে কণ্ঠ তার। চড়া স্বর। কক্ করে হাসল। মুরগী ডাকল যেন। লাফিয়ে উঠল তার সাদা গোফ।
পুরানো একটা রূপকথার বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিল রবিন। তাড়াতাড়ি বইটা নামিয়ে রেখে কনুই দিয়ে গুতো মারল মুসাকে। ফিসফিস করে বলল, চলো, কেটে পড়ি। যেমন কাকু-কাকু, তেমনি রেডরোজ। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আমার।
গ্যারেজের ভেতরে একটা টেবিল চোখে পড়ল মুসার। এমন করে রাখা, প্রায় দেখাই যায় না। তাতে ডজনখানেক ছোট ছোট পুতুল। রবিনের কথা অগ্রাহ্য করে গ্যারেজে ঢুকে পড়ল সে। পুরানো র্যাকে রাখা ততোধিক পুরানো কতগুলো কোটের পাশ দিয়ে ঘুরে এগোল টেবিলটার দিকে।
কাছে যাওয়ার পর বুঝল, ওগুলো পুতুল নয়। বাতিদান। কালো কাঠ কুঁদে তৈরি করা হয়েছে রূপকথার ড্রাগন, এলভস জাতীয় নানা রকম দৈত্য-দানবের। প্রতিকৃতি।
একটা বাতিদান হাতে তুলে নিল সে। কল্পিত জীবটার অর্ধেক শরীর মানুষের, অর্ধেক ঘোড়ার।
পাশে এসে দাঁড়াল রবিন। বিচ্ছিরি। ইঁদুরের লেজের মত লম্বা লেজওয়ালা হোঁকা একটা মূর্তির দিকে হাত বাড়াল। এটা কোন জীব?
মুসা কিছু বলার আগেই ধমকে উঠল কাকু-কাকু। অ্যাই, ছেলেরা। কি চুরি করা হচ্ছে?
উঠে দাঁড়াল সে। জ্বলন্ত নীল চোখের দৃষ্টি দুজনের ওপর স্থির। দুই হাত কোমরে রেখে রাগত ভ্রুকুটি করতে থাকল।
হাত থেকে বাতিদানটা ছেড়ে দিল রবিন। তোতলাতে শুরু করল, না না, আ-আমরা কিছু চুরি করছি না।
আমরা শুধু দেখছিলাম, মুসা বলল।
ওগুলো ছোটদের জিনিস নয়, ক্রুদ্ধ স্বরে জবাব দিল কাকু-কাকু। যাও, বাড়ি যাও। অন্যের বাড়িতে ছেকছেক কোরো না এসে।
রাগ লাগল মুসার। কান গরম হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিক্রির জন্যেই তো রেখেছেন এ সব।
বিক্রির জন্যে রেখেছি, চুরির জন্যে নয়…
দেখুন, আমরা চোর নই…
যাবে? নাকি ডাক দেব কুত্তাটাকে? কাকু-কাকুর চোখের ঠাণ্ডা নীল দৃষ্টি যেন বিদ্ধ করতে লাগল ওদের।
চলো, মুসার হাত ধরে টান দিল রবিন, লোকটা…পাগল!
দুটো টেবিলের মাঝখান দিয়ে বেরোনোর পথ। রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে রেডরোজ। মুসা তার পাশ কাটানোর সময় ধাক্কা লাগল। মুসার মনে হলো, তাসের খেলা ধাক্কাটা রেডরোজই দিল। সবতে গিয়ে পা পিছলাল মহিলা। পতন ঠেকানোর জন্যে মুসার শার্ট খামচে ধরল। ধমকে উঠল, এই, দেখে চলতে পারো না!
কিন্তু আপনিই তো ধাক্কা দিলেন…
চুপ! বেয়াদব ছেলে কোথাকার!
নাহ্, এদের সঙ্গে পারা যাবে না। সবগুলো উদ্ভট। নিজেই দোষ করে নিজেই ধমকাচ্ছে। কি কাণ্ড! হাল ছেড়ে দিল মুসা।
আর কোন অঘটন যাতে না ঘটে, সে-ব্যাপারে সতর্ক থাকল। সাবধানে বাইরে বেরিয়ে এল।
সোজা হাঁটা দিল বাড়ির দিকে। যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে এসে। পেছন ফিরে তাকাল না আর।
বাড়ি পৌঁছে দেখল রান্নাঘরের দরজা বন্ধই রয়েছে। তারমানে বাবা-মা এখনও ফেরেননি বাইরে থেকে। পকেটে হাত দিল চাবির জন্যে।
হাতে লাগল জিনিসটা।
বিস্ময় ফুটল চেহারায়।
ধীরে ধীরে বের করে আনল হাতটা।
অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।
কি জিনিস? জানতে চাইল রবিন।
রবিনের দেখার জন্যে হাতটা বাড়িয়ে দিল মুসা।
চারকোনা, আয়তাকার একটা বাক্স।
রবিন বলল, তাসের বাক্স মনে হচ্ছে না?
নীরবে মাথা ঝাঁকাল মুসা। দরজা খোলার জন্যে চাবি বের করল পকেট থেকে।