কিন্তু কোন কাজই হলো না।
মনে হচ্ছে যেন ভয়াবহ এই চুলকামিতেই মারা যাবে।
চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। পোকায় ছাওয়া খড়ের গাদা থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইছে। চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ফেলতে, কাপড় ছিঁড়তে, খামচে চামড়া তুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
কোনদিনই এ চুলকানি আর বন্ধ হবে না, নিজেকে বলল সে। বাকি জীবনটা এ ভাবে চুলকে চুলকেই কাটাতে হবে।
নাহ, আর সওয়া যায় না! পাশ থেকে বলতে শুনল রবিনকে। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। মরলে মরব। তা-ও না চুলকে আর পারব না।
তবে মুসা তুলনামূলকভাবে স্থির রয়েছে। ফিসফিস করে বলল, চুপ! জেকিলরা এখনও ধারে কাছেই আছে।
যন্ত্রণার চোটে গায়ে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল কিশোরের। কমানোর কোন উপায় নেই। গায়ের ওপর চেপে রয়েছে ভয়াবহ খড়।
কান থেকে একটা পোকা বের করে ফেলল সে।
ফেলতে না ফেলতেই আরেকটা উঠে এল নাকের ওপর। ঢুকে গেল নাকের ফুটো দিয়ে।
না না! এ কাজও কোরো না! নিজেকে আদেশ দিল সে।
কিন্তু কথা শুনল না হাঁচি।
প্রচণ্ড জোরে হ্যাঁচ্চোহ করে উঠল সে।
.
১৯.
ওর হাঁচির শব্দ মিলাতে না মিলাতেই ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে উঠল কয়েকজন। তারপর বাগত চিৎকার-চেঁচামেচি।
বেরিয়ে পালানোর সময় নেই আর। একাধিক পায়ের শব্দ ছুটে আসতে শোনা গেল।
অনেকগুলো হাত একসঙ্গে ঢুকে গেল খড়ের গাদায়। পা চেপে ধরে টেনে টেনে বের করে ফেলল কিশোরকে।
বিজাতীয় একটা ভাষায় অনর্গল কথা বলছে লোকগুলো, যার একটা বর্ণও বুঝতে পারল না সে। রবিন আর মুসাকেও বের করে ওরা আছড়ে ফেলল খড়ের গাদার নিচের শক্ত মাটিতে।
দ্রুত তিনজনকে ঘিরে ফেলল ওরা। কম করে হলেও ডজনখানেক বামন হবে। তীক্ষ্ণধার বল্লমের ফলা তিনজনের গায়ের কাছে কয়েক ইঞ্চি দূরে এসে থেমে গেল। নড়াচড়া করলেই দেবে ঘ্যাঁচ করে বিঁধিয়ে। ওদের চেহারায় প্রচণ্ড রাগ।
বুক চুলকাল কিশোর। শার্টের নিচ থেকে একটা পোকা বের করে এনে ছুঁড়ে ফেলল মাটিতে।
পাগলের মত চুলকে চলেছে রবিন আর মুসা। পোকা ফেলছে গা থেকে। দুনিয়ার আর কোনদিকে খেয়াল নেই যেন।
রবিনের চুলে চার-পাঁচটা পোকা ঘুরে বেড়াতে দেখে থাবা দিয়ে ফেলে দিল কিশোর।
অবশেষে, ফিরে তাকাল খুদে মানুষগুলোর দিকে, ওদের যারা বন্দি করেছে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কেউ ইংরেজি জানো?
কলরব বন্ধ হয়ে গেল ওদের। ওদের এলোমেলো, জট বেঁধে যাওয়া লম্বা চুলের নিচের চোখ দুটো পাতা সরু করে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দার দিকে। আরও সতর্ক ভঙ্গিতে চেপে ধরল হাতের বল্লমগুলো।
ইংরেজি? লোকগুলোর ওপর দৃষ্টি ঘুরাতে থাকল কিশোর। জানো কেউ?
কৌতূহলী হয়ে গোয়েন্দাদের দিকে তাকিয়ে রইল লোকগুলো। যেন কল্পনাই করতে পারেনি বন্দিরা কথা বলতে পারে।
চলো যাই! মরিয়া হয়ে চিৎকার করে উঠল মুসা। এখানে আমরা থাকব কিসের জন্যে?
নীরবতা।
লোকগুলোর বল্লমের ফলা আরও এগিয়ে এল দুএক ইঞ্চি। ওদের ঘিরে থাকা চক্রটা আরও ছোট হয়ে এল।
গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াল মুসা, কিশোর আর রবিন।
খুদে লোকগুলোর মাথার ওপর দিয়ে চক্রটার বাইরে তাকাল কিশোর। পালানোর পথ খুঁজছে তার চোখ। লোকগুলোর ওপাশে সমতল মাঠ ছাড়া আর রয়েছে সারি সারি গোল কুড়ে। প্রতিটি কুঁড়ের সামনে জ্বলছে একটা করে ছোট অগ্নিকুণ্ড।
ঢোক গিলল সে। পালানোর পথ নেই। লুকানোর জায়গা চোখে পড়ল না।
পিঠে চোখা ফলার খোঁচা খেয়ে আউক করে উঠল সে।
লাফ দিয়ে সামনে এগোল।
ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করছে জেকিলেরা। পেছন থেকে বল্লম দিয়ে খোঁচা মারতে থাকল। নড়তে বলছে।
হাই! দাঁড়াও! চিৎকার করে উঠল কিশোর। কণ্ঠের আতঙ্ক চাপা দিতে পারল না। কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তোমরা আমাদের?
আবার ঘোৎ-ঘোৎ। রাগত হট্টগোল। চাপা গর্জন।
লাফ দিয়ে আগে বাড়তে গেল মুসা। বল্লমের জোরাল খোঁচা এসে লাগল পিঠে।
নাহ্, বাঁচার কোন আশা নেই! হাল ছেড়ে দিল রবিন। একমাত্র পথ, গায়েব হয়ে যাওয়া।
যেটা কোনমতেই হওয়া যাবে না, যোগ করল মুসা।
অতএব বাঁচাও যাবে না।
এটা কিন্তু খেলা নয়, কিশোর বলল। কঠোর বাস্তব।
মাঠের ওপর দিয়ে ওদেরকে হেঁটে যেতে বাধ্য করল জেকিলরা। নিচু একটা কুঁড়ের সামনে এনে দাঁড় করাল। অগ্নিকুণ্ডের কাছে। আগুনের নিচে কড়কড় করে। কয়লা পুড়ছে। জ্বলন্ত রুবির মত। জোরাল বাতাসের ঝাঁপটা লাগল। ফুঁসে উঠল আগুন। লেলিহান শিখা লাফ দিয়ে ছুটে এল গোয়েন্দাদের দিকে।
কি করবে ওরা আমাদের, বলো তো? করুণ চোখে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। জীবন্ত কাবাব বানাবে?
কি জানি! নিচের ঠোঁট কামড়াল কিশোর। জানি না। তবে একটা কথা বলতে পারি। শিকারকে না মেরে জ্যান্ত ছিঁড়ে খায় না কখনও জেকিলরা।
এ রকম একটা তথ্যও খুশি করতে পারল না মুসা বা রবিনকে। শিরশির করে কাঁপুনি বয়ে গেল কিশোরের সারা দেহে। পা দুটো আর দেহের ভার রাখতে পারছে না।
ওদের মুখোমুখি বল্লম তুলে সারি দিয়ে দাঁড়াল জেকিলরা। আগুনের দিকে পেছন দিয়ে দাঁড়াতে বাধ্য করল।
আমরা কোন ক্ষতি করতে আসিনি তোমাদের! চিৎকার করে বলল কিশোর। কোন ক্ষতি করব না।
আমাদের ছেড়ে দাও! রবিনের কণ্ঠে কান্নার সুর। আমরা এখানে থাকি না। বাস করি না। আমাদেরকে আটকে রাখার কোন অধিকার তোমাদের নেই।
ঘোৎ-ঘোৎ করে নিজেদের মধ্যে কি সব আলোচনা করতে লাগল কয়েকজন। গোয়েন্দাদের দিকে নজর নেই। বাকিরা সব বল্লম তাক করে কড়া নজর রাখল যেন কোনমতেই পালাতে না পারে বন্দিরা।