ও বলেছে, কিশোর বলল, তাস যখন এত পছন্দ, তাসের জগতেই ঢুকে পড়ো তোমরা। তাসগুলো ছুঁড়ে মেরেছে আমাদের ওপর। তারপর এখানে পৌঁছে। গেছি আমরা।
তারমানে তাসের মধ্যে ঢুকে পড়েছি আমরা? চিৎকার করে উঠল মুসা। তাসের খেলায়? মুখোশ পরা নাইট আর আগুন ঝরানো ড্রাগনের দেশে?
অসম্ভব! বিড়বিড় করে বলল আতঙ্কিত রবিন।
হ্যাঁ, সত্যিই অসম্ভব। প্রতিধ্বনি করল কিশোর। কিন্তু সেটাই ঘটিয়ে বসে আছি আমরা।
কিন্তু…কিন্তু… কথা খুঁজে পেল না মুসা।
তীক্ষ একটা চিৎকার কানে আসতেই ফিরে তাকাল কিশোর।
খসখস শব্দ। পায়ের আওয়াজ। লম্বা ঘাসের ডগা বেঁকে যেতে দেখল সে।
লম্বা এক সারি খুদে মানুষকে ঘাসের মধ্যে সারি দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। গায়ে চামড়ার পোশাক। বড় বড় এলোমেলো চুলে ঢাকা মাথায় গম্বুজ আকৃতির ধাতব হেলমেট, তারার ভোতা আলোয় চকচক করছে। হাতে লম্বা, চোখা ফলাওয়ালা বল্লম।
হুপ! হুপ! হুপ! প! হাঁটার তালে তালে একনাগাড়ে বিচিত্র শব্দ করছে ওরা।
জেকিলস! ফিসফিস করে বলল কিশোর। সাবধান হয়ে গেল। ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ।
ঝট করে বসে পড়ল তিনজনে। লুকিয়ে পড়ল লম্বা ঘাসের মধ্যে।
আমি ওদের চিনে ফেলেছি, ফিসফিস করে বলল কিশোর। তাসের মধ্যেও ওদের ছবি ছিল। ওরা শয়তান…।
তাসের পেছনে আমিও লেখা দেখেছি, কম্পিত কণ্ঠে রবিন বলল। ওরা খুব দুষ্ট শিকারী। নিজেদের মাংস নিজেরা খায়। মানুষ তো খায়ই।
.
১৮.
হুপ! হুপ! হুপ! হুপ!
আতঙ্কিত হয়ে বামন-মানবগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা। মার্চ করে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। হাঁটার তালে তালে বল্লম উঠছে, বল্লম নামছে। এক ভাবে। এক ভঙ্গিতে।
ভারী দম নিল কিশোর। ঘাসের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে সরে যেতে শুরু করল লোকগুলোর চলার পথ থেকে।
হুপ! হুপ! হুপ! হুপ!
লোকগুলো কি ওদের দেখে ফেলেছে?
জানার জন্যে অপেক্ষা করা যাবে না।
হামাগুড়ি দিয়ে বেশ খানিকটা সরে গেল ওরা। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে মাথা নিচু করে লম্বা ঘাসের ভেতর দিয়ে দৌড় দিল কিশোর। রবিন আর মুসা ছুটল ওর পাশে পাশে।
ঘাসে ঢাকা নরম মাটিতে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে ছুটতে থাকল ওরা। কিন্তু ঘাসের গায়ে ঘষা লেগে শব্দ হয়েই যাচ্ছে। ফিরে তাকাল না। তবে কান পেতে রইল লোকগুলোর শিকার দেখতে পাওয়ার উল্লসিত চিৎকার শোনা যায় কিনা।
কোথায় যাব? কোথায় লুকাব? ভাবছে কিশোর।
বুকের মধ্যে পাগল হয়ে উঠেছে হৃৎপিণ্ডটা। ছোটার সময় হাঁপানোর শব্দকে কম করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল সে।
তারার ফ্যাকাসে আলোয় উঁচু খড়ের গাদাটাকে কাঁপা কাঁপা অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ওদের সামনে এক অতিকায় দৈত্যের মত।
এক মুহূর্ত দ্বিধা করল না সে। ভাবনা-চিন্তাও করল না বিশেষ। করার সময়ও নেই।
মাথা নিচু করে প্রায় ডাইভ দিয়ে পড়ল গাদাটার ওপর। এক পাশ থেকে ঢুকে পড়ল তার ভেতর।
ভেজা ভেজা। খসখসে। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো গা চুলকানো।
এক হাতে চোখ ঢেকে যতটা পারল গভীরে ঢুকে গেল ও। মুখেও খড়ের খোঁচা লাগছে। খোঁচা দিচ্ছে কাপড়ে ঢাকা চামড়াতেও। ধারাল খড়ের ডগা তেরছা ভাবে খোঁচা মেরে আচড়ে দিচ্ছে ঘাড়ের চামড়া।
খড়ের গাদার মধ্যে খড়খড় আওয়াজ পিলে চমকে দিল কিশোরের। পরক্ষণে বুঝতে পারল, মুসা আর রবিনও ঢুকেছে ওর পাশেই।
খাইছে! বলে উঠল মুসা। এ তো এক্কেবারে ভেজা!
আমাদের দেখে ফেলল নাকি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কি-কি জানি, তুতুলে বলল মুসা। থাক, আর কথা বলার দরকার নেই। শুনে ফেলবে…
চুপ হয়ে গেল ওরা।
কান পেতে আছে কিশোর। জেকিলাদের পায়ের শব্দ শোনার জন্যে।
কানে এল না।
হুপ হুপও করছে না আর।
চলে গেল নাকি?
নাকি খড়ের গাদা থেকে ওদের বেরোনোর অপেক্ষা করছে?
মুখের চামড়ায় খোঁচা মারছে খড়ের ডগা। নাকের ভেতর ঢুকে যাওয়া একটা ভেজা খড় সরিয়ে দিতে চাইল সে। যথেষ্ট বেগ পেতে হলো সরাতে।
ইস, এত চুলকান চুলকাচ্ছে, ফিসফিস করে বলল রবিন।
কিশোরের নিজেরও কম চুলকাচ্ছে না। কি জবাব দেবে? পিঠ…বুক…গাল…কোথায় চুলকাচ্ছে না!
সেই সঙ্গে ক্রমাগত খোঁচানো।
চামড়ায় জ্বলুনি শুরু হয়ে গেল। শরীর না মুচড়ে আর থাকতে পারল না। গায়ের ওপর চেপে থাকা খড় সরানোর চেষ্টা করল। চুলকানো থামিয়ে দিল। লাভ নেই। চুলকাতে গেলে কষ্ট আরও বাড়ে।
দাতে দাঁত চেপে স্তব্ধ হয়ে রইল। উফ, এত চুলকানি…এত চুলকানি…
হঠাৎ চাপা একটা গোঙানি যেন জোর করেই বেরিয়ে এল মুখ থেকে।
বেশ বড় বড় লাল রঙের এক ধরনের পোকা। মুখ থেকে টেনে সরাল একটাকে। আরেকটা ঘষা দিয়ে ফেলে দিল হাতের উল্টো পিঠ থেকে।
ঘাড়ের ওপর পোকা হেঁটে বেড়াচ্ছে সড়সড় করে। শার্টের কলার দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। হেঁটে বেড়াতে শুরু করল পিঠের ওপর।
শত শত লাল পোকায় ছেয়ে আছে খড়ের গাদা। মানুষের গন্ধ পেয়েই যেন এসে হাজির হলো। ঘুরে বেড়াতে শুরু করল ওদের গায়ের ওপর।
ইয়াক! করে উঠল কিশোর। একটা লাল পোকা ওর ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁটের কোণ দিয়ে মুখে ঢুকে পড়ল।
থু-থু করে ফেলে দিল ওটা। জিভে ঝজাল-টক স্বাদ আটকে থাকল অনেকক্ষণ। দাঁতে দাঁত চেপে ফাঁক বন্ধ করে রাখল এরপর। কোনমতেই যাতে আর পোকা ঢুকতে না পারে।
পোকা ঢুকে থাকার কথা কল্পনা করে আরও একবার থু-থু করে উঠল। গাল চুলকাল। খড়ের গাদায় ঘষে পিঠের চুলকানি বন্ধ করতে চাইল।