বাড়াবাড়ি মানে? রাগ তো কমলই না, বেড়ে গেল আরও কাকু-কাকুর। শয়তানিটা আমি করেছি, না তোমরা? চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি…
সহ্য করতে পারল না আর মুসা। রেগে উঠল, দেখুন, আমরা চুরি করিনি! আমরা চোর নই, বার বার বলছি আপনাকে। কিছুতেই বিশ্বাস করছেন না। তা ছাড়া কি করে জানব আমরা, তাস খেলে বাস্তবে ড্রাগন আর নাইট ডেকে আনা যায়? এ রকম গাঁজাখুরি কথা কেউ বিশ্বাস করবে? আগে খুলে বলেননি কেন সে কথা? আসলে, ভুল আমাদের সবারই হয়েছে। আপনিও বাদ যাবেন না।
হ্যাঁ, যেন একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল কাকু-কাকু। গোফের কোনায় চাড় দিতে শুরু করল। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুসার দিকে। ভুল। বড় রকমের ভুল। অনেক বেশি জেনে ফেলেছ তোমরা।
কাকু-কাকুর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। ঘাবড়ে গেল। পিছাতে গিয়ে ধাক্কা লাগল একটা উঁচু হেলানওয়ালা সোফায়। অনেক বেশি জেনে ফেলেছি। মানে? কি বলতে চান? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল তার কণ্ঠ।
ওর পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর আর রবিন।
প্রশ্নের জবাব দিল না কাকু-কাকু। অদ্ভুত হাসি ফুটল তার ফ্যাকাসে মুখে। তিন গোয়েন্দার ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে তাসগুলো সব বের করল প্যাকেট থেকে।
তাস যখন তোমাদের এতই পছন্দ, বিচিত্র হাসিটা ছড়িয়ে পড়ল সারা মুখে-তার গোফ জোড়াকে মনে হলো ডানা মেলে উড়ছে, নিজেরাই এর চরিত্র। হয়ে যাও না কেন? তাসের জগতেই ঢুকে পড়ো তোমরা।
মানে? দম আটকে এল মুসার। কি বলতে চান…
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই হাত গরিয়ে তাসগুলোকে শূন্যে উড়িয়ে দিল কাকু-কাকু।
ছুঁড়ে ফেলল মুসা, রবিন আর কিশোরকে লক্ষ্য করে।
ঘুরতে ঘুরতে, ওলট-পালট করতে করতে নিচে পড়তে লাগল তাসগুলো। ওদের মাথায়, ওদের কাঁধে। নীরবে ভাসতে ভাসতে মাটিতে নেমে গেল।
তাসগুলো সব মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার নেমে এল ওদের ওপর।
গাঢ়, ঠাণ্ডা অন্ধকার। এ রকম অনুভূতি আর আগে কখনও হয়নি ওদের।
ধীরে ধীরে ঘরটা মিলিয়ে গেল। কাকু-কাকু মিলিয়ে গেল। নিজেরাও পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছে না আর।
নড়ল না তিনজনের কেউ। মনে হচ্ছে পড়ে যাচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে। বরফের মত শীতলতার মধ্যে।
নিথর নীরবতার মধ্যে।
তারপর একটা বিস্ফোরণ ঘটল যেন নিজেদের দেহে। তীক্ষ্ণ ব্যথা। আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল আপনাআপনি।
ব্যথাটা বুকের কাছ থেকে ছড়িয়ে গেল সমস্ত শরীরে। বাহুতে। পায়ে। মাথার মধ্যে ফেটে পড়ল ব্যথা। ঝিমঝিম করতে থাকল।
মাথা…মাথা…ঝিমঝিম…
মনে হলো টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে মাথাটা।
মনে হলো কোটর থেকে খুলে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে চোখ। দাঁত খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে মুখ থেকে।
চিৎকার করতে থাকা ওদের হাঁ করা মুখ দিয়ে মগজটা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ করেই মনে হলো ওরে, এই অন্ধকার ওদের চেনা।
নিথর এই শীতল অন্ধকারটাকে চেনে ওরা।
মনে হতে লাগল, এটাই মৃত্যু।
.
১৭.
অন্ধকার কেটে যাওয়ার আগেই যেন ধুয়ে চলে গেল শীতলতা। গরম ঢেউয়ের ধাক্কা এসে লাগল যেন শরীরে।
কয়লা-কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। অন্ধকার চাদরের মধ্যে মিটমিট করছে কতগুলো আলোর ফোঁটা। তাসের খেলা
তারা?
হ্যাঁ। তারকা খচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মেঘমুক্ত আকাশ। ঝিরঝিরে বাতাস। চুল কাপে।
হাঁটুতে ভর দিয়ে রয়েছে, বুঝতে পারল। হাঁটু আর হাতের তালুতে। চার হাত-পায়ে। লম্বা ঘাসের মধ্যে।
বাতাস এত তাজা। এত মিষ্টি। দারুণ সুবাস।
বেঁচে আছি! আমি বেঁচে আছি! প্রথমেই এ কথাটা মনে পড়ল ওর।
কানে এল গোঙানির শব্দ। ওর পাশে থেকে। ঘাসের মধ্যে খসখস শব্দ।
হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এল রবিন। চোখের পাতা সরু সরু করে তাকাল কিশোরের দিকে। যেন চিনতে পারছে না। ঝাঁকি দিয়ে চুল থেকে কুটো ফেলল। ফিসফিস করে বলল, কিশোর, কোথায় রয়েছি আমরা?
তাই তো! কোথায় রয়েছি? লম্বা ঘাসের মধ্যে রবিনকে অনুসরণ করে। বেরিয়ে এল মুসা।
ভালই তো আছি দেখা যাচ্ছে, জবাব দিল কিশোর। যদিও গলা কাঁপছে তার। আমার মনে হচ্ছিল মগজ ফেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, মারা যাচ্ছি।
কিন্তু আমরা এখন কোথায়? আবার প্রশ্ন করল রবিন। ছিল সকাল। এখন তো দেখতে পাচ্ছি রাত।
নিজেকে টেনে তুলল কিশোর। খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল। চওড়া একটা মাঠের মধ্যে রয়েছি আমরা। সমতল মাঠ।
রবিন আর মুসাও উঠে দাঁড়াল।
চারপাশে তাকাতে তাকাতে মুসা বলল, কোন খামার-টামারের সামনে রয়েছি।
লম্বা ঘাসের মাঠ ছাড়িয়ে ওপাশে কমলা রঙের ছোট ছোট আগুনের কুণ্ড দেখতে পেল সে। গোল, নিচু কতগুলো কুঁড়েঘরের সামনে জ্বলছে।
গ্রামটাম হবে, কিশোর বলল। ঘরগুলো দেখো। ঘাস কিংবা খড় দিয়ে তৈরি।
অদ্ভুত! বিড়বিড় করল মুসা
ধূসর রাতের আলোতে ভাল করে দেখা যায় না। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে তাকাল কিশোর। উঁচু একটা খড়ের গাদা চোখে পড়ল। ওটার পাশে উবু হয়ে আছে। একটা ঠেলাগাড়ি। ছোট ছোট আরও দুটো ঠেলাগাড়ি চোখে পড়ল ওদের। দূরে কুঁড়ের সারির কাছেই কোনখান থেকে ভেসে এল একটা ঘোড়ার ডাক।
ঘাড় থেকে থাবা মেরে লাল একটা পোকা ফেলল রবিন। অনেক রাত হয়ে গেছে। বাড়ি যাওয়া দরকার। জায়গাটাও আমার ভাল লাগছে না।
মনে তো হচ্ছে বাড়ি যাওয়াটা অত সহজ হবে না, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা; বাড়ি থেকে বহু দূরে রয়েছি আমরা। কাকু-কাকু কি করেছে। আমাদের? এতই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, কি যে বলছিল খেয়ালই করিনি। ঠিকমত।