শুনছেন? ডেকে জিজ্ঞেস করল সে। কেউ আছেন?
পরক্ষণেই ধড়াস করে এক লাফ মারল তার হৃৎপিণ্ড। লাফ দিয়ে পিছিয়ে এল। সে। সামনের ঘর থেকে ভেসে এল একটুকরো তীক্ষ্ণ হাসির শব্দ।
.
১৬.
দরজার কাছে পিছিয়ে আসতে গিয়ে ধাক্কা খেল কিশোর আর রবিনের গায়ে। মুসা। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ির মাথায় উঠে এসেছে ওরা।
আ-আছে..ঘ-ঘ-ঘরেই আছে সে… তোতলাতে শুরু করল মুসা।
আবার শোনা গেল তীক্ষ্ণ, উচ্চকিত হাসি।
আমার কাছে তো বাচ্চাদের হাসির মত লাগছে, মুসার গা ঘেঁষে এসে ফিসফিস করে বলল রবিন। কিংবা কোন জানোয়ারের।
ফ্যাকাসে এক ফালি রোদ পড়েছে লিভিং রূমে। সেটা ধরে প্রায় গায়ে গায়ে লেগে থেকে এগোতে শুরু করল ওরা। ঘরের অন্ধকার চোখে সয়ে এলে দেখা গেল ঘর ভর্তি পুরানো আসবাবপত্র। কয়েকটা খাড়া হেলানওয়ালা কাঠের চেয়ার আছে। একটা টেবিল আছে, তাতে এলোমেলো ভাবে নানা রকম জিনিস ছড়ানো। একটা ভাঙাচোরা পিয়ানো আছে। ছোট একটা টেবিলে রাখা একটা রূপার বল। জানালায় এত ভারী পর্দা টানা যে, আলোই আসতে পারছে না।
আবার হাসির শব্দ শোনা গেল।
ফিরে তাকাল মুসা। হাসিটা কোথা থেকে আসছে, শব্দ সৃষ্টিকারীটা কে, দেখে ফেলল।
একটা বানর। ছোট একটা বাদামী বানর একটা পিতলের খাঁচার মধ্যে উত্তেজিত ভঙ্গিতে লাফালাফি করছে। বানরের ভাষায় কিচকিচ করে চলেছে। সমানে।
বাহ, সুন্দর তো বানরটা! রবিন বলল। খাঁচাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
তীক্ষ কিচির-মিচির থামিয়ে দিল বানরটা। মাথা কাত করে তাকিয়ে দেখতে লাগল রবিনকে।
পোষাই তো মনে হচ্ছে, রবিনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। সাবধানে তাকিয়ে আছে বানরটার দিকে। নাকি আগে মানুষ ছিল, কাকু-কাকু জাদু করে ওকে বানর বানিয়ে ফেলেছে?
না, ও সব সময়ই বানর ছিল। পেছন থেকে বলে উঠল একটা তীক্ষ্ণ খসখসে কণ্ঠ।
কাকু-কাকুর গলা চিনতে পেরে চরকির মত পাক খেয়ে দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াল মুসা।
শীতল গোল গোল কুতকুতে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে কাকু-কাকু। সাদা চুলগুলো মাথার পেছনে ঘাড়ের কাছে খাড়া হয়ে আছে। মখমলের লাল আলখেল্লার নিচে ডোরাকাটা পাজামা পরেছে।
মিস্টার কাকু-কাকু… শুরু করতে গেল মুসা।
এখানে কি তোমাদের? রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করল কাকু-কাকু। এখন কটা বাজে? এত সকালে এসে ঘুম ভাঙালে কেন আমার? নাকি বাড়িটা খালি ভেবে আর লোভ সামলাতে পারোনি। চুরি করতে ঢুকে পড়েছ?
না-না! তোতলাতে শুরু করল মুসা, আ-আ-আমরা আপনার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি। আ-আমরা…
বেশ দেখা তো হলো আমার সঙ্গে। চিৎকার করে উঠল কাকু-কাকু। সব সময় এ ভাবে চুরি করেই লোকের সঙ্গে দেখা করতে ঢোকো নাকি?
না। দরজাটা খোলাই ছিল, জবাব দিল মুসা।
চুরি করে ঢুকিনি আমরা, এতক্ষণে কথা বলল কিশোর। ঢোকার আগে বেশ কয়েকবার বেল বাজিয়েছি।
ব্যঙ্গের স্বরে বলল কাকু-কাকু, তাই নাকি…
বাধা দিয়ে রবিন বলল, দেখুন, আমরা সত্যি বলছি! চুরি করার সামান্যতম ইচ্ছে আমাদের নেই!
চোয়াল ডলল কাকু-কাকু। গোঁফের মাথা দুটো টেনে লম্বা করে দিল। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে গোয়েন্দাদের দিকে। তোমরা কেন এসেছ, আমি জানি, অবশেষে বলল সে।
অ, জানেন…জানবেনই তো… পেছনের পকেট থেকে তাসের প্যাকেটটা বের করে আনল মুসা। কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই যে, নিন!
জ্বলে উঠল কাকু-কাকুর নীল চোখ। তাহলে তোমরাই বাক্সটা চুরি করেছিলে।
না, আমরা চুরি করিনি, মুসা বলল।
তাহলে তোমাদের কাছে গেল কি করে?
মিস লীলা রেডরোজ চুরি করে আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিল সেদিন। আমাদেরকে দিয়ে খেলিয়ে প্রতিবেশীদের ক্ষতি করে তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত মুসার দিকে তাকিয়ে রইল কাকু-কাকু। তারপর কিশোর আর রবিনের ওপর ঘুরে এসে আবার মুসার ওপর স্থির হলো তার দৃষ্টি। অ, তারমানে খেলাটাও তোমাদেরই কাজ। ড্রাগন ডেকে এনেছ। আরেকটু হলেই ধ্বংস করে দিচ্ছিলে তোমাদের পুরোটা ব্লক।
হয়তো, শান্তকণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। কিন্তু তারপরেও স্বীকার করব না, দোষটা আমাদের। কারণ, ওরকম এক প্যাকেট তাস হাতে পেলে আপনিও খেলতে বসতেন। তাস খেলাটা দোষের কিছু না। কিন্তু সেটা যে এ রকম বাস্তব হয়ে উঠবে, সব কিছু ধ্বংস করে দেবে, সেটা কে জানত? যখনই বুঝলাম বিপজ্জনক, ফেরত দিতে নিয়ে এলাম।
যখন আনতে গেলাম, তখন দিলে না কেন? রেগে উঠল কাকু-কাকু।
তখন দিলে চোর বলতেন আমাদের।
এখনও যদি বলি?
বললে বলুনগে। এখন চোর বললে, আর ততটা গায়ে লাগবে না। কারণ, আমরা বুঝে গেছি, তাসগুলো বিপজ্জনক। যা-ই বলুন, কোন কিছু আর কেয়ার করি না। কারণ, কারও ক্ষতির কারণ আর হতে চাই না আমরা। কিন্তু একটা কথা বলুন তো, আপনিই বা এ রকম এক প্যাকেট বিপজ্জনক তাস বিক্রির জন্যে রেখেছিলেন কেন? যে কিনত, সে কি ভাবছেন খেলত না? ক্ষতির কারণ হত না? আর না জেনে ক্ষতি করলে দোষটা কার ওপর বর্তাত? ভুরু নাচাল কিশোর। আপনার ওপর। কারণ আপনিই এগুলোর আসল মালিক।
মানুষের ক্ষতি তো করেছই, আবার বেশি চোরের মার বড় গলা… থাবা দিয়ে মুসার হাত থেকে প্যাকেটটা কেড়ে নিল কাকু-কাকু।
দেখুন যা হবার হয়ে গেছে, পরিস্থিতিটাকে হালকা করার জন্যে বলল রবিন, কাকু-কাকুকে ভয় পাচ্ছে সে। এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই।